উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পেলেও সিঙ্গুরের জমি ফেরাতে রাজি নয় টাটা মোটরস। আজ সুপ্রিম কোর্টে এ কথা জানিয়ে টাটাদের তরফে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে ওই জমিতে কারখানা গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। প্রয়োজনে ন্যানো গাড়ির কারখানার দ্বিতীয় ইউনিটও গড়া যেতে পারে।
২০১১-এর ১৪ জুন বিধানসভায় সিঙ্গুর আইন পাশ করার সাত দিনের মধ্যে রাজ্য সরকার সিঙ্গুরের জমি দখল নেওয়ার পর মামলা এখন সুপ্রিম কোর্টে গড়িয়েছে। রাজ্য সরকারের আইনকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে প্রথমে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছিল টাটা মোটরস। সিঙ্গল বেঞ্চ সরকারের পক্ষে রায় দিলেও ডিভিশন বেঞ্চ বলে সিঙ্গুর আইন অবৈধ। সেই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে রাজ্য।
গত ১০ জুলাই সেই মামলার শুনানির সময় শীর্ষ আদালত টাটা মোটরসের কাছে জানতে চেয়েছিল, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পেলে সিঙ্গুরের জমি তারা ছেড়ে দিতে রাজি আছে কি না। একই সঙ্গে বিচারপতিদের প্রশ্ন ছিল, যে কারণে এই জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, সেই শিল্পই যদি না-হয়, তা হলে জমি কেন আসল মালিকের কাছে ফেরত যাবে না। |
শীর্ষ আদালতের এই প্রশ্নের পরে সিঙ্গুর-জট কাটার আশা দেখেছিলেন কেউ কেউ। রাজ্য সরকারের তরফে আদালতের বক্তব্যকে ইতিবাচক আখ্যা দিয়ে দাবি করা হয়েছিল, অনিচ্ছুক চাষিদের জমি ফেরানোর পথ এ বার উজ্জ্বল হল। কিন্তু অনেকেই তখন সেই সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কারণ, সিঙ্গুর আইন অবৈধ না বৈধ, সেই মূল প্রশ্নেরই মীমাংসা হয়নি। আইন বৈধ বলে স্বীকৃতি পেলে তবেই ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন উঠবে। আর আজ টাটারা জমি ছাড়তে রাজি নয় বলে জানানোর পরে জমি ফেরানোর বিষয়টা আরও গভীর জলে চলে গেল বলেই তাঁদের মত। টাটাদের বক্তব্য জানার পরে সিঙ্গুর আইনের বৈধতা সংক্রান্ত মূল মামলার শুনানি আগামী বছর এপ্রিল মাসে শুরু হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
টাটাদের এ দিনের বক্তব্য শুনে সংশ্লিষ্ট মহলের অনেকেই মনে করছেন, সিঙ্গুর নিয়ে আপাতত আইনি পথেই হাঁটতে চায় তারা। ফলে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির আগে জমি ফেরতের বিষয়টি অনিশ্চিত থেকে যাবে বলেই তাঁদের মত।
টাটাদের অবস্থান জানার পরে রাজ্য সরকারের তরফে প্রকাশ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। তবে একান্ত আলাপচারিতায় প্রশাসনিক কর্তারা বলছেন, অনিচ্ছুক চাষিদের ৪০০ একর জমি ফিরিয়ে দেওয়া হবে, এটাই সরকারের নীতি। এটাই মুখ্যমন্ত্রীর অঙ্গীকার। সেখান থেকে সরে আসার কোনও কারণ ঘটেনি এবং সরকার সরে আসবেও না।
যদিও টাটাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে তাদের সিঙ্গুরে প্রত্যাবর্তনের পথ প্রশস্ত করলে রাজ্যের বিবর্ণ শিল্পচিত্রে নতুন রং জুড়তে পারে বলেই মনে করছে বিরোধী ও শিল্পমহল। প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনের বক্তব্য, রাজ্যের উচিত, টাটার এই অবস্থানকে স্বাগত জানানো। তাঁর মন্তব্য, “সিঙ্গুর থেকে টাটাকে তাড়ানো তো ওঁদের (তৃণমূল) লক্ষ্য ছিল না। লক্ষ্য ছিল বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করা। সেটা যখন হয়েই গিয়েছে, তখন টাটাকে ফিরিয়ে এনে নিজেরাই দরকারে কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন! আমাদের আপত্তি নেই।”
কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার প্রতিক্রিয়া, “রাজ্য সরকার টাটাদের নিয়ে পুরো ব্যাপারটা পর্যালোচনা করে যদি ভবিষ্যতের কোনও রূপোলি রেখা দেখাতে পারে, তা হলেই ভাল।” অন্য দিকে, বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট কল্লোল দত্তের কথায়, “এটা ভাল খবর যে, টাটা মোটরস এ রাজ্য থেকে একেবারে মুখ ঘুরিয়ে নেয়নি। এ বার রাজ্যের উচিত বিষয়টি মিটমাটের জন্য ওদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা। ওরা ফিরে এলে রাজ্যের শিল্পায়নের ছবিটা দ্রুত বদলে যাবে।”
সিঙ্গুরের জমি শিল্পের জন্য ব্যবহার করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে আজ বিচারপতি এইচ এল দাত্তু ও বিচারপতি রঞ্জনাপ্রসাদ দেশাইয়ের ডিভিশন বেঞ্চে টাটা মোটরসের আইনজীবী হরিশ সালভে জানান, ২০০৮ সালে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে তাঁর মক্কেলের পক্ষে কাজ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। কিন্তু ওই জমি তারা ছেড়ে দিতে চায় না। কারণ, জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন আইন পাশ হওয়ার পরে এক লপ্তে জমি পাওয়া অসুবিধা। সে ক্ষেত্রে সিঙ্গুরের ৯৯৭ একর জমি কারখানা তৈরির কাজে লাগাতে চায় টাটারা। ওই জমিতে অনুসারী শিল্প তথা পরিকাঠামোগত সব সুবিধা তৈরি করাই রয়েছে। গুজরাতের সানন্দে ন্যানোর একটি ইউনিট তৈরি হয়েছে। প্রয়োজনে দ্বিতীয় ইউনিট তৈরির কাজ শুরু করা যেতে পারে সিঙ্গুরে।
সিঙ্গুর নিয়ে টাটাদের বিস্তারিত পরিকল্পনা কী, তা অবশ্য আদালতকে জানাননি হরিশ সালভে। তিনি বলেন, বর্তমানে রাজ্য ওই জমি পুনর্দখল করেছে। ফলে কতটা জমি তাঁর মক্কেলের হাতে আসবে, তা জানার পরেই বিস্তারিত পরিকল্পনা জানানো সম্ভব।
টাটাদের এই বক্তব্য সম্পর্কে রাজ্য সরকারের একটি সূত্রের মন্তব্য, ন্যানো কারখানার দ্বিতীয় ইউনিট গড়ার জন্য হাজার একর জমির কোনও প্রয়োজন নেই। অনিচ্ছুক চাষিদের ৪০০ একর জমি ফেরত দিয়েও কারখানা গড়া সম্ভব। আদালতে রাজ্যের এই অবস্থানের কথা সময়মতো স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেওয়া হবে বলেও সূত্রটি জানান।
রাজ্য সরকারের আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য আজ দাবি করেন যে, আদালতে টাটারা মিথ্যে কথা বলেছেন। তাঁর কথায়, “সিঙ্গুরের জমি নেওয়া হয়েছিল ন্যানো গাড়ির মূল কারখানা গড়া হবে বলে। তা হলে এখন কারখানা সম্প্রসারণের প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে?” কারখানা সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে টাটা মোটরস তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারকে যে চিঠি দিয়েছিল, সেটিও আদালতে পেশ করেন কল্যাণবাবু।
আপস রফার মাধ্যমে সিঙ্গুরের জমি টাটারা ছেড়ে দিচ্ছে না, এটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরে সিঙ্গুর আইনের বৈধতা সংক্রান্ত মূল মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করার আর্জি জানিয়েছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু সেই আর্জি খারিজ করে দেয় ডিভিশন বেঞ্চ। আগামী এপ্রিলে মূল মামলার শুনানি হবে বলে আজ জানিয়ে দিয়েছে তারা।
|