প্রবন্ধ ১...
এ যাত্রায় কংগ্রেস ছাড়া গতি নেই
দর্শের মিলই যদি নির্বাচনী জোটের প্রধান বিবেচ্য হয়, তবে ২০১৪ সালে জোটসঙ্গী হিসেবে বামপন্থীদের প্রথম পছন্দ কার হওয়ার কথা, তা নিয়ে তর্কের কোনও অবকাশই নেই। তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাসভাড়া হোক বা খুচরো ব্যবসায় বিদেশি পুঁজি, ডিজেলে ভর্তুকি থেকে পেনশন খাতে সংস্কার, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় বিশ্বাস সব প্রশ্নেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বামপন্থা নিখাদ, আগমার্কা। কিন্তু, আদর্শের এহেন মোক্ষম মিলও যেহেতু কালীঘাট আর আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের মধ্যে সেতু বাঁধতে পারবে না, ফলে প্রকাশ কারাটদের অন্য জোটসঙ্গীই খুঁজতে হবে।

সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকতে হলে জোট ছাড়া বামপন্থীদের উপায় নেই। তাঁরা ফের তৃতীয় ফ্রন্টের মঞ্চ সাজাতে উঠেপড়ে লেগেছেন বটে, কিন্তু সেই পশ্চিমবঙ্গও নেই, লোকসভায় সেই ষাট আসনের দাপটও থাকবে না। সীতারাম ইয়েচুরি নিজেই স্বীকার করেছেন, যে দলগুলোকে নিয়ে তাঁরা তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ার স্বপ্ন দেখেন, সেই আঞ্চলিক দলগুলির অধিকাংশই সুবিধাবাদী। ফলে, নির্বাচনের পর যখন জোট ভাঙা-গড়ার খেলা আরম্ভ হবে, সেই খেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পেতে গেলে দলের সাইনবোর্ডটুকু থাকলেই হবে না, সাংসদও প্রয়োজন হবে। ২০১৪ সালে কংগ্রেস এবং বিজেপি, উভয় পক্ষই ‘ছোট’ দলগুলির মুখাপেক্ষী হবে, ঠিকই, যে ছোট দলগুলির হাতে সংখ্যা থাকবে, কেবলমাত্র তাদের। সেই হিসেবে, ২০১৪ সালের বসন্ত-গ্রীষ্মে দিল্লিতে এক বামপন্থীর প্রবল প্রতাপ থাকার সম্ভাবনা। তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
পথ কোথায়? প্রকাশ কারাট ও সীতারাম ইয়েচুরি।
ক্ষমতার সমীকরণ অদলবদলের সেই ঋতুতে প্রাসঙ্গিক থাকতে হলে, অতএব, হাতে যথেষ্ট আসন রাখতে পারা ছাড়া সিপিএম-এর বিকল্প নেই। সেখানেই পশ্চিমবঙ্গের গুরুত্ব। কেরল আর ত্রিপুরা আছে বটে, কিন্তু লোকসভায় সিপিএম-এর এযাবৎ কালের দাপট মূলত পশ্চিমবঙ্গ-নির্ভর ছিল। তার প্রথম কারণ, কেরল আর ত্রিপুরার সম্মিলিত লোকসভা আসনের সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গের অর্ধেকের চেয়ে মাত্র একটি বেশি। দ্বিতীয় কারণ, কেরলে বিধানসভায় এল ডি এফ ক্ষমতায় থাকুক আর না-ই থাকুক, লোকসভা নির্বাচনে, কেবলমাত্র ২০০৪ সাল ছাড়া, বামপন্থীরা কখনও মারাত্মক ভাল ফল করেননি। অতএব, লোকসভায় নিজের শক্তিতে দাপট চাইলে পশ্চিমবঙ্গই ভরসা। সে গুড়ে আপাতত তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১৪ সালে একা লড়লে ২০০৯-এর তুলনায় ফল খারাপ হওয়ার সম্ভাবনাই তুমুল।
পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরা অবশ্য বলতে পারেন, হিসেব অত সহজ নয়। এ বার যদি তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট না হয়, এবং বিজেপি যদি অন্তত তার স্বাভাবিক ভোটটুকু পায়, তা হলে ভোট ভাগাভাগির অঙ্কে বামফ্রন্টের আসনসংখ্যা বাড়তে পারে। বেশ কয়েকটা লোকসভা আসনকে চিহ্নিতও করে ফেলা যায়, যেখানে একক শক্তিতে লড়তে হলে তৃণমূলকে মুশকিলে পড়তে হবে। সেই মুশকিলে বামপন্থীদের লাভ। কাগজ-কলমের হিসেবে এই অঙ্কটাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া মুশকিল। কিন্তু, ভগ্নাংশ আর ত্রৈরাশিকের এই জটিল অঙ্কে একদা লাল দুর্গ এই পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা দাঁড়ানোর জমি খুঁজছেন, এটা এক অর্থে ঐতিহাসিকই বটে।
এই অনিশ্চিত সমীকরণের হাতে ভবিষ্যৎ গচ্ছিত না রাখতে চাইলে বামপন্থীদের সামনে নির্বাচনের আগেই জোট গড়া ছাড়া বিকল্প নেই। এবং, এমন সঙ্গীর সঙ্গে জোট, যার পশ্চিমবঙ্গে খানিক হলেও উপস্থিতি আছে। অক্টোবরের শেষে দিল্লিতে যে মঞ্চে তৃতীয় ফ্রন্টের একটা প্রাথমিক মহড়া হল, তার বিজু জনতা দল, এআইএডিএমকে, জনতা দল ইউনাইটেড, অথবা সমাজবাদী পার্টি বা এনসিপি কেউই বামপন্থীদের পশ্চিমবঙ্গের বৈতরণী পার করতে পারবে না। পশ্চিমবঙ্গে পায়ের তলায় মাটি পেতে গেলে বামফ্রন্টের বাইরের কোনও দলের ওপর নির্ভর না করে উপায় নেই রাজ্যের বামপন্থীদের এই কথাটি মানতে কষ্ট হবে। কিন্তু বাস্তব যখন, তাকে মেনে নেওয়াই ভাল। এই অবস্থায় বামপন্থীদের সামনে বিকল্প মাত্র একটি তার নাম কংগ্রেস। জোট না হোক, কংগ্রেসের সঙ্গে অন্তত একটা বোঝাপড়াও তাঁদের সুবিধাজনক জায়গায় নিয়ে যেতে পারে।
এই কথাটি প্রকাশ কারাটের মনপসন্দ হবে না। তিনি দিনকয়েক আগেও বললেন, সামনে দুই শত্রু দুর্নীতিগ্রস্ত কংগ্রেস এবং সাম্প্রদায়িক বিজেপি। কারাটের মতে কংগ্রেসের আরও এক দফা পাপ আছে তাদের ভ্রান্ত নীতিতে দেশের ক্ষতি হয়েছে। কংগ্রেস ও বিজেপি, দু’দলকেই হারাতে হবে। তাঁর এই কংগ্রেস-বিরোধিতায় ২০০৯ সালে সিপিএম যথেষ্ট ভুগেছে। সে বার তবুও অস্তিত্বের সংকট ছিল না। এ বারও প্রকাশ কারাটই শিরোধার্য হলে বিপদ আছে।
কেন কংগ্রেসই সিপিএম এবং অন্যান্য বামপন্থী দলগুলির ‘স্বাভাবিক মিত্র’, তার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। প্রথমত, কারাট যতই কংগ্রেসকে ‘বাজার অর্থনীতির ধামাধরা’ বলে গাল পাড়ুন, একুশ শতকের মাপকাঠিতে কংগ্রেস রীতিমত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে বিশ্বাসী। কারাটও অস্বীকার করতে পারেননি যে প্রথম দফার ইউপিএ সরকার সাধারণ মানুষের জন্য অনেক করেছে। ২০০৯ সালের পর, যখন থেকে সংখ্যায় অনেক ক্ষীণ সিপিএম ফের বিরোধী আসনে বসতে আরম্ভ করল, দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার উন্নয়নের অর্থনীতির ভাষ্যটি সম্পূর্ণ বদলে দিল। সাধারণ মানুষের জন্য উন্নয়নকে আর রাজনীতিকদের সদিচ্ছার মুখাপেক্ষী না রেখে তাকে অধিকারের মর্যাদা দেওয়া হল। তাতে কতটা কাজ হয়েছে, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি তার সুফলগুলোকে গিলে খেয়েছে কি না, এই প্রশ্নগুলোর কোনওটাই অস্বীকার করার নয়। কিন্তু বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুলতম দেশের সরকার যদি সিদ্ধান্ত করে যে দেশের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের খাদ্য সংস্থানের দায়িত্ব অতঃপর আইনি ভাবেই ক্ষমতাসীন সরকারকে বহন করতে হবে, তার অভিঘাত মারাত্মক। ২০১৪ সালে এবং তার পরের লোকসভা নির্বাচনগুলিতে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, উন্নয়নের অধিকারকে অস্বীকার করা কারও পক্ষেই সম্ভব হবে না।
শিক্ষা হোক বা খাদ্য এই প্রাথমিক বিষয়গুলিকে মানুষের অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তো বামপন্থীদের তোলার কথা ছিল। কারাটদের চাপ ছাড়াই ইউপিএ সরকার এই কাজগুলি করেছে। লাতিন আমেরিকার সমাজতন্ত্রী দেশগুলিতে যে প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তর প্রকল্প বেশ সফল হয়েছে, ভারতের গরিব মানুষদের জন্য এই প্রকল্প নিয়ে আসার কৃতিত্বও ইউপিএ সরকারের। এর পরও যদি কংগ্রেসকে আদর্শগত ভাবে কাছের বলে মনে না হয়, তা হলে সেটা প্রকাশ কারাটদের মনের সমস্যা।
দ্বিতীয়ত, কংগ্রেস কখনও সিপিএম-এর জন্য দরজা বন্ধ করেনি। প্রধানমন্ত্রী একাধিক বার বলেছেন, সঙ্গী হিসেবে বামপন্থীরা স্থিতিশীল। কোন দলের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, অনুমান করার জন্য বাড়তি নম্বর নেই। আকবর রোডের হাইকম্যান্ড বিলক্ষণ জানে, পশ্চিমবঙ্গে একা লড়লে আসনসংখ্যা দুই পেরোবে না। ফলে, কংগ্রেস জোট চায়। সিপিএম বোঝাপড়া থেকে সরে থাকলে তৃণমূলের সঙ্গেও জোট হতে পারে। সেটা বঙ্গজ বামপন্থীদের পক্ষে আনন্দের হবে না।
শুধু মুখের কথাই নয়, কংগ্রেস অনেক ভাবে সিপিএম-এর জন্য দরজা খুলে রেখেছে। তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হল চেন্নাই, কলকাতাসহ ছ’টি বিমানবন্দরের বেসরকারিকরণের কাজ স্থগিত রাখা। বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্তটি সরকারি ছিল। সংসদীয় কমিটির প্রধান সীতারাম ইয়েচুরি তাতে নীতিগত আপত্তি জানিয়েছেন যে প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ বেসরকারি হাতে চলে যাবে, তিনি তাঁর বিরোধী। কমিটির সুপারিশ না মানার অধিকার সরকারের বিলক্ষণ আছে। কংগ্রেস সে পথে হাঁটেনি। ইয়েচুরির আপত্তি মেনে নিয়ে সিদ্ধান্তটি জানুয়ারি পর্যন্ত স্থগিত রেখেছে। রাস্তা খোলা থাকল জানুয়ারিতেও খানিক তানানানা করে লোকসভা নির্বাচনের দিন ঘোষণা অবধি সিদ্ধান্তটি ঝুলিয়ে রাখা যাবে। আর তার পর নির্বাচনী বিধি মেনেই আর এই সিদ্ধান্ত করা চলবে না। বেসরকারিকরণ নিয়ে বামপন্থীদের নৈতিক আপত্তি সম্পূর্ণ বজায় থাকবে তাতে।
জমি বিলের ক্ষেত্রে বামপন্থীদের পরামর্শ মেনেছে সরকার। এলপিজি-র ভর্তুকিপ্রাপ্ত সিলিন্ডারের সংখ্যা ছয় থেকে বাড়িয়ে নয় করেছে। ডিজেলের দাম যতটা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তার চেয়ে খানিক হলেও পিছু হঠেছে। অর্থাৎ, ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ এই প্রশ্ন করার কোনও জায়গাই নেই। কংগ্রেস হাত বাড়িয়েই রেখেছে। এখন সেই হাতটি আঁকড়ে ধরাই সিপিএম-এর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার একমাত্র পথ। কারাট আপত্তি করবেন। পশ্চিমবঙ্গের নেতাদের কর্তব্য, দলের সর্বভারতীয় সম্পাদকের আপ্রাণ বিরোধিতা করা।
তৃতীয় কারণ নরেন্দ্র মোদী। তিনি তাঁর যাবতীয় সাম্প্রদায়িক, এবং একনায়কোচিত অতীতসমেত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে চাইছেন। বামপন্থীদের আর হাজারটা খামতি থাকতে পারে, তবু, ১৯৮৯ সালের ব্রিগেডে হাতধরাধরি সত্ত্বেও, তাঁদের ‘সাম্প্রদায়িক’ বলার উপায় নেই। বস্তুত, ২০১১ সালের ধসের আগে রাজ্যের মুসলমান ভোটে কার্যত একচেটিয়া অধিকার ছিল তাঁদের। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন তাঁদের সামনে সেই হারানো জমি পুনরুদ্ধারের একটা সুযোগ করে দিয়েছে। ‘যে কোনও উপায়ে হোক, নরেন্দ্র মোদীকে ঠেকাতেই হবে’ সিপিএম যদি যথেষ্ট আন্তরিক ভাবে এই বার্তাটি দিতে পারে, তা হলে মুসলিম ভোটব্যাঙ্কের একটা বড় অংশ ফের তাদের দিকে ঝুঁকবে, সে সম্ভাবনা প্রবল। কিছু না হোক, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহসটুকু প্রমাণ হবে। তা-ও কম নয়।
কংগ্রেসকে নিয়ে যে ঐতিহাসিক ছুৎমার্গ রয়েছে, এ বেলায় সে ঝেড়ে ফেললেই সিপিএম-এর মঙ্গল। প্রয়োজনে পার্টি লাইন নতুন করে লিখতে হবে। তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থানের পর রাজ্যে কংগ্রেস আর তাদের প্রধান শত্রু নয়। বস্তুত, গত লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট যেমন বাম-বিরোধী ভোটকে একত্রিত করতে পেরেছিল, এই দফায় সিপিএম-কংগ্রেস জোট ঠিক সেই কাজটাই করতে পারে তৃণমূল কংগ্রেস-বিরোধী ভোটকে একত্র করা। পারলে, কংগ্রেসের লাভ। সিপিএম-এর তো বটেই।
যে রাজ্যে এখনও কংগ্রেসই সিপিএম-এর বৃহত্তম শত্রু, সেই কেরলে কী হবে? এই প্রশ্ন উঠবেই। উত্তর নেই, তেমনটা নয়। রাজ্যওয়াড়ি বোঝাপড়ার কথাও ভাবা যায়। কিন্তু ভুললে চলবে না, দলের ভিতরে কেরল লবি যতই শক্তিশালী হোক, দেশে দলের পরিচয় এখনও পশ্চিমবঙ্গের জোরেই। সে জোর ধরে না রাখতে পারা-না পারার ওপরেই তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব নির্ভরশীল। অন্তত, ২০১৪ সালে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.