সরকারি হাসপাতালে রকমারি অব্যবস্থার অন্যতম হইল রোগীকে স্থানান্তরে লইবার জন্য ট্রলি না-পাওয়া। প্রতিটি হাসপাতালেই নাকি পর্যাপ্তসংখ্যক ট্রলির জোগান আছে। অন্তত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি তেমনই। কিন্তু প্রয়োজনের সময় রোগীর আত্মীয়রা তাহা পান না। পঞ্চাশ কিংবা একশো টাকার নগদ বিদায়ের মূল্যে যদি ভাগ্যক্রমে ওয়ার্ড-বয়’রা তাহা সরবরাহ করিতে সম্মত হন, তাহা হইলে রোগীর প্রাণ বাঁচে। গত শনিবার কলিকাতার নীলরতন সরকার হাসপাতালে এমন ট্রলির অভাবেই প্রসূতিকে লেবার-রুমে হাঁটাইয়া লইবার সময় পথিমধ্যে প্রসব হইয়া নবজাতক মেঝেয় পড়িয়া মাথায় আঘাত পাইলে তাহার মৃত্যু হয়। এই মর্মান্তিক ঘটনার প্রতিক্রিয়াতেই মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তদন্তের নির্দেশ দিয়াছেন, তাহাতে স্বাস্থ্য দফতর দৃশ্যত নড়িয়া বসিয়াছে, সরকারি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষও নাকি সজাগ হইয়াছে।
তবে শেষ পর্যন্ত এই সবের পরিণাম কত দূর কী হইবে, সে বিষয়ে ঘোর সংশয় থাকিয়া যায়। এ ধরনের এক-একটি অপকাণ্ড ঘটিবার পর রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের যে সাময়িক তৎপরতা দেখা যায়, তাহার প্রভাব প্রশাসনের উপর বেশি দিন স্থায়ী হয় না। পরিস্থিতি শান্ত হইয়া গেলে আগের অব্যবস্থাই ফিরিয়া আসে। কারণ অব্যবস্থাই এখানে নিয়ম। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে যেমন ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে, ট্রলি লইয়া কায়েমি স্বার্থচক্রের যে ঘুঘুর বাসা হাসপাতালগুলিতে কায়েম রহিয়াছে, তাঁহারা নাকি হাজার চেষ্টাতেও তাহা ভাঙিতে পারিতেছেন না। কেমন করিয়া পারিবেন? এই চক্র তো তৈয়ার করিয়াছেন এক শ্রেণির কর্মী, যাঁহাদের ইউনিয়ন আছে, রাজনৈতিক দলের পতাকা আছে, অপকর্মের জন্য শাস্তি দিলে প্রতিবাদের নামে ধর্মঘট করার, অচলাবস্থা সৃষ্টির ‘গণতান্ত্রিক’ অধিকার আছে। চক্র ভাঙিতে হইলে ইউনিয়ন ভাঙিতে হইবে, নিদেনপক্ষে রাজনৈতিক দলের অনুগত ইউনিয়ন ভাঙিতে হইবে। অন্যথা রোগীর আত্মীয়দের কাছ হইতে ট্রলি পিছু তোলা আদায়, ট্রলি ঠেলিবার জন্য অতিরিক্ত তোলা আদায়ের ঐতিহ্য ভাঙা যাইবে কী রূপে? চক্র তো কেবল ট্রলি লইয়া নয়, ওয়ার্ড হইতে রোগীর রক্তের নমুনা পরীক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগে লইয়া যাইতেও টাকা দিতে হয়। বিভিন্ন কাজের জন্য পদে-পদে এই চক্রের হাতে রোগীর নিরুপায় স্বজনরা টাকা গুঁজিয়া দিতে বাধ্য হন। এ ভাবেই হাসপাতালগুলিতে দরিদ্র রোগীরা ‘নিখরচায়’ বা ‘সামান্য খরচে’ চিকিৎসা পাইয়া থাকেন! হাসপাতাল প্রশাসনের পক্ষে এই চক্র ভাঙা সম্ভব নয়, যত ক্ষণ না রাজনীতিকরা কর্মী ইউনিয়নের পিছন হইতে সমর্থনের মইটি কাড়িয়া লইতেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর মানবিকতা ও সংবেদনশীলতা তাঁহাকে দ্রুত তদন্ত করিয়া রিপোর্ট জমা দিবার নির্দেশ দিতে প্রাণিত করিয়াছে। কিন্তু কর্মীদের ইউনিয়নে দলীয় নেতাদের পরিপুষ্টি এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে অচলাবস্থা সৃষ্টির অমানবিকতাকে কি তিনি শায়েস্তা করিতে পারিবেন? বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গের অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতো স্বাস্থ্য-পরিষেবা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রেও যে আগের জমানার অব্যবস্থার কোনও মৌলিক পরিবর্তন হয় নাই, এই ঘটনাগুলি তাহারই সংকেত দেয়। স্বাস্থ্য দফতর হাসপাতালের প্রশাসনকে কঠোর হইতে বলিয়াছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কঠোর হইলে স্বাস্থ্য-ভবন আবার কর্মচারীদের পক্ষ লইবে না তো? |