শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় অনুষ্ঠেয় কমনওয়েল্থ রাষ্ট্রজোটের শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ হাজির না-থাকার সিদ্ধান্ত লইয়াছেন। সিদ্ধান্তটি দুর্ভাগ্যজনক। ইহা যে প্রধানমন্ত্রীর দফতর হইতে গৃহীত হয় নাই, বরং কংগ্রেস হাইকমান্ডের তরফেই গৃহীত হইয়াছে, তাহা বুঝিতে অসুবিধা নাই। সিদ্ধান্তটির পিছনে প্রাদেশিক রাজনীতির সংকীর্ণ স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রবণতাটি স্পষ্ট। বস্তুত, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় বিদেশ নীতির অভিমুখ বদলাইয়া ফেলার এক উদাহরণ এই সিদ্ধান্ত, শ্রীলঙ্কার সহিত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সুযোগসুবিধা জলাঞ্জলি দিয়া তাহাকে দূরে ঠেলিয়া দিবার অপরিণামদর্শিতা যাহাতে প্রকট। ‘নীতি-পঙ্গুত্ব’ যে কেবল ভারতীয় অর্থনীতির দিশাকে স্থবির করে নাই, বিদেশ নীতিতেও আগ্রাসন ঘটাইয়াছে, এই সমালোচনা অতঃপর মনমোহন সিংহের সরকারকে মানিয়া লইতে হইবে।
এমন নয় যে, শ্রীলঙ্কা-তামিলদের প্রতি সে-দেশের সরকারের নীতিতে কোনও বৈষম্য বা জাতিবৈর নাই, যাহার প্রতিবাদ করা উচিত। দেশান্তরের জ্ঞাতিভ্রাতাদের করুণ দুর্দশার প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা জ্ঞাপনের সূত্রে ভারতীয় তামিল রাজনীতিতে কমনওয়েল্থ সম্মেলন বয়কটের যে ডাক উঠিয়াছে, তাহার গুরুত্বও অস্বীকার করার নয়। কানাডার প্রধানমন্ত্রী তো দ্বীপরাষ্ট্রের তামিলদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদেই বৈঠক বয়কট করার সিদ্ধান্ত লইয়াছেন। কিন্তু কানাডা আর ভারত এক নয়। শ্রীলঙ্কার সহিত ভারতের সম্পর্ক এবং উপমহাদেশে তথা দক্ষিণ এশিয়ায় সেই সম্পর্কের সূত্রে ঘনীভূত রণনৈতিক বিষয়গুলি উপেক্ষণীয় নয়। অঞ্চলের অন্যান্য উপকূল রাষ্ট্র তথা সমুদ্রবেষ্টিত দেশের সহিত চিন যে নিবিড় নৈকট্য স্থাপন করিতেছে, তাহার প্রেক্ষিতেও নয়াদিল্লির পক্ষে কলম্বোর প্রতি কঠোর ঔদাসীন্য বিধেয় নয়। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যদি নয়াদিল্লির তামিল আবেগকে তুষ্ট করার বাধ্যতা থাকে, তবে বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কাকে চিনের কোলে ঠেলিয়া না-দিবার সচেতন তৎপরতা চালাইবার বাধ্যতা আছে। বস্তুত, কলম্বোয় প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতি লোকসভা নির্বাচনে ইউপিএ বা কংগ্রেসের ঝুলিতে বাড়তি কয়টি আসন আনিয়া দিবে, সে বিষয়ে বিলক্ষণ সংশয় আছে। অথচ শ্রীলঙ্কাকে বিরূপ করিয়া তুলিলে, বিশ্বসভায় তাহাকে হেয় বা একঘরে করার চেষ্টা করিলে তাহার কূটনৈতিক ও রণনৈতিক মূল্য নয়াদিল্লির পক্ষে বেশি পড়িতে পারে। মনমোহন সিংহ কিন্তু শীর্ষ সম্মেলনের আন্তর্জাতিক মঞ্চকে ব্যবহার করিয়াই দ্বীপভূমির তামিলদের প্রতি ঘটিতে থাকা বৈষম্য, নির্যাতন ও প্রতারণার প্রতিবাদ জানাইতে পারিতেন। সেই পথে তামিলদের দলিত মানবাধিকার ফিরাইয়া দিয়া তাঁহাদের সসম্মান পুনর্বাসনের দাবিও তোলা যাইত। ব্রিটিশ জনমতের চাপে ক্যামেরন এবং অস্ট্রেলিয়ার নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবট সম্ভবত তাহাই করিতে চলিয়াছেন। মনমোহন সিংহ উপরন্তু উত্তরের তামিল প্রদেশের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী বিঘ্নেশ্বরণের আমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া জাফ্না সফরেও যাইতে পারিতেন। তাহাতে শ্রীলঙ্কার তামিলদের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান জানানো যাইত। প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপক্ষের সরকার যেটুকু তামিল স্বশাসন মঞ্জুর করিতেছে, তাহাকে মর্যাদা দিয়া আরও স্বশাসনের জন্য সওয়াল করা যাইত। ভারত যে সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতাবাদের পক্ষপাতী নয়, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনপ্রণালীর সমর্থক, তাহাও বুঝাইয়া দেওয়া যাইত। মন্দের ভাল এইটুকুই যে, প্রধানমন্ত্রী নিজে গরহাজির থাকিলেও বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল কলম্বো যাইতেছে। তাহাতে অবশ্য তাঁহার ব্যক্তিগত অনুপস্থিতির বার্তাটুকু প্রত্যাহৃত হইতেছে না। |