সবে মঞ্চ থেকে মাটিতে পা পড়েছে। কিন্তু তখনও চোখেমুখে রোমাঞ্চ। হবেই বা না কেন! স্বয়ং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে ওঁরা চেক নিয়েছেন। ওঁরা মানে, দুবরাজপুরের চাঁদনিহার খাতুন, রামপুরহাটের শেখ রেজাউলরা। এক জন ‘কন্যাশ্রী’, অন্য জন ‘যুবশ্রী’ প্রকল্পে অনুদান পেলেন। উচ্ছ্বসিত হয়ে দু’জনেই বললেন, “আবেদন করেছিলাম। কিন্তু কখনও ভাবিনি দিদির হাত থেকেই ওই চেক পাব। দিদির জন্যই স্বপ্ন বাস্তব হল!”
মঙ্গলবার দুপুরে ইলামবাজারে প্রশাসনিক জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবারই বীরভূম নিয়ে তাঁর আলাদা নজর রাখার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। সেই সঙ্গে জেলার জন্য একগুচ্ছ প্রকল্পের উদ্বোধন করে তাঁর নিজের স্বপ্নও বাস্তব রূপ দেন। তাঁর অভিযোগ, আগের রাজ্য সরকারের আমলে এই জেলার কোনও উন্নতিই হয়নি। তাই জেলার প্রতিটি ব্লকে তিনি উন্নয়ন পৌঁছে দিতে চান। এই জেলার কাজ নিয়ে অবশ্য খুশিই দেখা যায় মুখ্যমন্ত্রীকে। |
সভার আগে ইলামবাজার ব্লক কৃষি আধিকারিকের কার্যালয়ে জেলার বিভিন্ন ব্লকের বিডিও এবং ওসিদের নিয়ে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে চলা প্রশাসনিক বৈঠকেও জেলা প্রশাসনকে তিনি এ ব্যাপারে কার্যত দরাজ হাতে সার্টিফিকেটও দেন। পরে সভাতেও বলেন, “পঞ্চায়েত ভোটের জন্য এখানে (বীরভূম) আমরা কাজের দিক থেকে পিছিয়ে ছিলাম। কিন্তু জেলা প্রশাসনের তৎপরতায় আবার কাজের গতি ঠিক হয়েছে।”
বস্তুত, এ দিন ‘দিদি ম্যাজিক’ দেখতে ইলামবাজারের গ্রন্থাগার মাঠে তিলধারণের জায়গাও ছিল না। আড়াইটে নাগাদ সভা শুরু হলেও তার কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই মানুষ সভা ভরতে শুরু করেন। পুলিশের হিসেবে প্রায় ১০ হাজার মানুষের সমাগম হয়েছিল। বীরভূমের নানা প্রান্ত থেকে তো বটেই লাগোয়া বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদ থেকেও বাস ভর্তি করে সভায় লোক এসেছিলেন। মাঠে জায়গা না পেয়ে জনতা এক সময়ে লাগোয়া বাড়ির ছাদে ও গাছের ডালেও উঠে পড়েন। এ দিন সভা সংক্ষিপ্ত হওয়ায় অনেকেই অবশ্য হতাশ হন। তবে মুখ্যমন্ত্রী যেটুকু সময় মঞ্চে ছিলেন, তাতেও অনেকেই সন্তুষ্ট। উপস্থিতদের উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রীর বরাভয়, “না খেতে পেয়ে কেউ যেন মারা না যান। সরকার সব সময়ই আপনাদের পাশে আছে।” |
মঞ্চে জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা, এসপি সি সুধাকর, সাংসদ মুকুল রায়, মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ, দলের জেলা চেয়ারম্যান বিধায়ক আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, লাভপুরের বিধায়ক মনিরুল ইসলাম, নানুরের বিধায়ক গদাধর হাজরা, সিউড়ির বিধায়ক স্বপনকান্তি ঘোষ, বীরভূমের জেলা সভাধিপতি বিকাশ রায়চৈাধুরীকে মুখ্যমন্ত্রীর পাশেই ছিলেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলও। মুখ্যমন্ত্রীর সামনে অনুব্রত দলীয় ঐক্যের চেহারাই তুলে ধরলেন বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। তবে উল্লেখযোগ্য অনুপস্থিতি, বীরভূমের তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায়ের।
এ দিন পূর্ব ঘোষিত প্রকল্পের কোনগুলির কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে, কোনগুলি শেষের মুখে, মুখ্যমন্ত্রী তার কয়েকটিরও ফিরিস্তি দিয়েছেন। তিনি বলেন, “এই জেলায় এখনও পর্যন্ত সাড়ে ৪ লক্ষ চাষিকে কিষান ক্রেডিট কার্ড বিলি করা হয়ে গিয়েছে। বাকি ৫০ হাজারকেও তাড়াতাড়ি দেওয়া দেওয়া হবে।” ওই ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার করে চাষিদের সুযোগ-সুবিধা নিতেও তিনি উৎসাহী করেন। একই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী জানান, ডিসেম্বরের মধ্যে ২২ হাজার বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে। ছ’ মাসের মধ্যে ক্যাম্প গড়ে এপিএল, বিপিএল কার্ডধারীদের বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার কাজ শেষ করা হবে। জেলায় কোল ব্লককে কেন্দ্র করে ১ লক্ষ বেকারকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও তিনি দেন। |
আগামী ডিসেম্বর থেকে জঙ্গলমহলের ধাঁচে বীরভূমের ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া ৭টি ব্লকেও ২ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়া শুরু হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। সভায় মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন, বোলপুরে আইটি হাবের কাজ শুরু হয়েছে। সেখানে দ্রুত আইটি পার্ক, ফুড পার্ক গড়া হবে। মঞ্চ থেকেই প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে দুনিগ্রামে সেতু নির্মাণ, ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজনগরে পানীয় জলপ্রকল্প-সহ একগুছ প্রকল্পের শিলান্যাস করেন। |
সভা যখন শেষের মুখে, তখন মঞ্চের নীচ থেকেই কয়েক জন সিভিক পুলিশ ও আশাকর্মী মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানান। দিদিকে এত কাছে পেয়ে তাঁরা নিজেদের দুরবস্থার কথা তুলে ধরেন। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নিয়মিত কাজ এবং স্থায়ী বেতনের আবেদন করেন সিভিক পুলিশেরা। তবে মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের স্পষ্ট করে দেন, “সিভিক পুলিশ নিয়মিত কাজ পাবেন না। যখন প্রয়োজন হবে, তখনই তাঁদের কাজে লাগানো হবে।” বেতন বৃদ্ধির দাবি জানান কয়েক জন আশাকর্মীও। মঞ্চ থেকেই মুখ্যমন্ত্রী বলে ওঠেন, “এখনই বেতন বৃদ্ধি সম্ভব নয়। বামফ্রন্টের আমলে তো বেতনই পেতেন না। আমি এসে মাসে তেরোশো থেকে পনেরোশো টাকা বেতন চালু করেছি।” যদিও আশাহত ওই কর্মীদের মঞ্চ থেকেই দরকারের কথা কাগজে লিখিয়ে জানানোর পরামর্শ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। |