নিষ্প্রাণ এলাকাগুলিতে এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অরাজকতা। অবাধ, অনিয়ন্ত্রিত।
লাগাম টানতে মঙ্গলবার ফিলিপিন্সের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শহর টাকলোবানে ‘বিশেষ বাহিনী’ নামাতে হল সরকারকে। উদ্ধারকাজের পাশাপাশি দিনভর চলল আইনশৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টাও। রাতে ‘কার্ফু’ জারি করা হয়েছে টাকলোবানে। কিন্তু ঝড়ের মুখে প্রায় খড়কুটোর মতো উড়ে যাওয়া শহরের এখনও হুঁশ ফেরেনি। তথ্য বলছে, মঙ্গলবার টাকলোবানের মোট ২৯৩ জন পুলিশকর্মীর মধ্যে কাজে এসেছিলেন মাত্র ২০ জন। বাকিদের বেশিরভাগই মৃত অথবা নিখোঁজ। টাকলোবান আপাতত তাই প্রশাসনহীন। সুযোগ বুঝে জাঁকিয়ে বসছে অপরাধের চক্র। মঙ্গলবারই সেখানকার একটি জেল ভেঙে পালিয়েছে বেশ ক’জন বন্দি।
এর সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। সরকারি হিসেব মতো, এ পর্যন্ত হাইয়ানের তাণ্ডবে গোটা ফিলিপিন্সে প্রাণ হারিয়েছেন ১, ৭৪৪ জন। তবে, অসমর্থিত সূত্রের মতে, সংখ্যাটা শুধু টাকলোবানেই দশ হাজার। ফিলিপিন্সের বহু গ্রাম এবং শহরের সঙ্গে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। উদ্ধারকারী দলও পৌঁছতে পারেনি সে সব এলাকায়। ফলে সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা ঠিক কোথায় পৌঁছবে, তা ভেবে থই পাচ্ছে না প্রশাসন। এ দিকে মঙ্গলবার নতুন একটি নিরক্ষীয় ঝড়ের জেরে প্রবল বর্ষণ শুরু হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলিতে। ফলে বাধা পাচ্ছে উদ্ধারকাজ। টাকলোবানের বহু এলাকায় এখনও কোমর-সমান জল। তাতে ভেসে বেড়াচ্ছে অগুনতি দেহ। গণকবর, গণচিতার আয়োজন করছে প্রশাসন। কিন্তু তাতেও কুলোচ্ছে না। |
আর যাঁরা কোনওক্রমে বেঁচে গিয়েছেন, তাঁদের কী অবস্থা? খাবার নেই, ওষুধ নেই। পানীয় জল? তা-ও মিলছে না। সহায়সম্বলহীন মানুষগুলো তাই মারমুখী হয়ে উঠেছেন। টাকলোবানের এক দোকান-মালিক এমা বারমেজো বললেন, “লোক জন অসম্ভব ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত। আর ক’দিনের মধ্যে এরা নিজেরাই একে অপরকে মারতে শুরু করবেন।” কিন্তু তার পরই এমার প্রশ্ন, “আমার ব্যবসা শেষ। দোকানটা পুরোটাই লুঠ হয়ে গিয়েছে। যদি খাবার এবং জল চুরির জন্য এ সব হত, তার মানে ছিল। কিন্তু এর মধ্যেও টিভি, ওয়াশিং মেশিন চুরি? লজ্জার ব্যাপার।” লজ্জার কথা স্বীকার করছেন এডওয়ার্ড গুয়ালবের্তোও। হাইয়ানের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত একটি গ্রামের কাউন্সিলর তিনি। তিন দিন ধরে পেটে একফোঁটাও দানাপানি পড়েনি। বাধ্য হয়ে তাই অন্যের ঘরে ঢুকে তাঁদের খাবার খেয়েছেন। তবে সে বাড়িতে কারও অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। কারণ বাসিন্দারা সকলেই মৃত। আর সেই লাশের উপর পা রেখেই ঘরে ঢুকেছেন এডওয়ার্ড। ম্লান মুখে বললেন, “এই কালান্তক টাইফুন সভ্যতার পাঠ ভুলিয়েছে আমাদের।”
বাস্তবিক। ফি বছরে গড়ে ২০ থেকে ২৪টি টাইফুন আছড়ে পড়ে ফিলিপিন্সে। কিন্তু এ বারের মতো অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি। সব চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দুটি প্রদেশ লেইট এবং সামারের অবস্থা শোচনীয় বললেও কম। বহু এলাকা জলের তলায়। পথে প্রান্তরে ভাসছে দেহ। বেশিরভাগই শিশুর। দেখেশুনে উদ্ধারকারী দলের ধারণা, এই দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি প্রাণ গিয়েছে খুদেদেরই। অথচ পরিস্থিতি বোঝার উপায় নেই। জল পেরিয়ে এখনও প্রত্যন্ত জায়গায় পৌঁছতেই পারছে না উদ্ধারকারী দল। অগত্যা তাই বাবার কোলে সওয়ার হয়েই মর্গে পৌঁছচ্ছে শিশুকন্যার দেহ। কোথাও বা কোলের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছেন মা। শোক, হাহাকার, কখনও বা পরিচিত মুখ খুঁজে বেড়ানো। ফিলিপিন্সের সমুদ্র-সংলগ্ন এলাকার ছবিটা কিছুটা এ রকমই।
ত্রাণের কাজ শুরু করা হয়েছে। সরকার তো বটেই, সাহায্য আসছে আমেরিকা, ব্রিটেন থেকে। ভারতও সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বার্তা দেন, “আমরা সমস্ত রকম সাহায্য দিতে প্রস্তুত।” ত্রাণ নিয়ে বিমানবাহী মার্কিন জাহাজ ইতিমধ্যেই রওনা দিয়েছে ফিলিপিন্সের দিকে। ব্রিটেনও নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ পাঠাবে। ত্রাণ পাঠাচ্ছে চিন, জাপানও। এগিয়ে এসেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ।
কিন্তু হাইয়ানের অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে যে বেশ অনেকটা সময় লেগে যাবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত প্রশাসন। ফিলিপিন্সের অর্থসচিব সিজার পুরিসিমার আশঙ্কা, ঝড়ের ফলে নারকেল এবং ধানের ফলনে যে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, তাতেই আগামী বছরে আর্থিক বৃদ্ধি অন্তত ১ শতাংশ কমবে। সম্পত্তি, পরিকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি, তার হিসেব এখনই সম্ভব নয়। কিন্তু সব কিছু পেরিয়ে ভেসে আসছে ক্যারল মামপাসের কণ্ঠস্বর “আমাদের আর কিছু রইল না। বাড়ি নেই, টাকা নেই, কোনও তথ্য-নথি নেই, পাসপোর্ট, স্কুলের রেকর্ড কিছুই নেই।”
ম্যানিলাগামী সরকারি বিমানে চড়তে টাকলোবান বিমানবন্দরে ক্যারলের মতো ভিড় করেছিলেন অনেকেই। শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থদের ঠাঁই মিলেছে বিমানে। বাকিরা আক্ষরিক অর্থেই ‘অথৈ জলে’। দিশাহীন।
|
টাইফুন হাইয়ানের প্রভাবে চিনে এখনও পর্যন্ত মারা গিয়েছেন ৮ জন। বন্যার জেরে কার্যত বন্দি হয়ে পড়েছেন একটি স্কুলের অন্তত ১ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং পড়ুয়া। ওই স্কুলবাড়ির কয়েকটি তলা ইতিমধ্যেই জলের তলায় চলে যাওয়ায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা। স্থানীয় প্রশাসন সূত্রের খবর, তাঁদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
|