কয়েক বছর ধরেই একটু একটু করে ভোল বদলাচ্ছিল কাটোয়ার কার্তিক পুজো। ঐতিহ্যবাহী ‘থাকা’র পাশাপাশি অন্য সব পুজোর মতো এই পুজোতেও জুড়ছিল থিম ভাবনা। তবে এ বছর থিম, ভিন্ন ধারার মণ্ডপের পাশাপাশি ‘থাকা’র চেহারাতেও বৈচিত্র্য আনতে চলেছেন উদ্যোক্তারা।
কাটোয়ায় প্রায় তিনশো বছরের পুরনো কার্তিক পুজোর ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে রয়েছে ‘থাকা’। এই ‘থাকা’ আসলে পিরামিডের মতো দেখতে এক বাঁশের কাঠামো যেখানে থাকে থাকে মাটির পুতুল সাজানো থাকে। পুতুলের মাধ্যমে পুরাণের বিভিন্ন কাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়। প্রচলিত থাকার দু’ধারে থাকে সখী আর মাথায় কাত্যায়ণী। |
তবে গত বছর সেই নিয়মে কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম ঘটিয়েছিলেন কিছু পুজো উদ্যোক্তা। এ বার অবশ্য ভাবনা আরও এক ধাপ এগিয়েছে। কাটোয়ার ঝঙ্কার ক্লাব পিরামিডের আদলে বাঁশের কাঠামোর ধরণটাই বদলে ফেলছে। ‘থাকা’র চেহারা বদলাতে দিনরাত এক করে কাজ করছেন শিল্পীরা। মুখ্য ভূমিকা নিয়েছেন ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী তাপস দাস। ক্লাব চত্বরে দাঁড়িয়ে তিনি জানান, পিরামিডের মতো ‘থাকা’য় একটা দিকই শুধু দেখা যায়। কিন্তু এ বারের ‘থাকা’য় সবদিকই দর্শক দেখতে পাবেন। তিনি আরও জানান, আগে তিন কোনা করে ‘থাকা’ বাঁধা হত। তার উপর কয়েকটা ধাপ করা হত। কিন্তু এ বার গোল করে বাঁশের কাঠামো গড়ে ‘থাকা’ তৈরি হচ্ছে। এতে চারটে থাক থাকবে, যাতে পুতুল সাজানো হবে। আর পুতুলের পিছন দিকে প্লাইউড দিয়ে বাঁশের কাঠামো ঢেকে দৃশ্যাঙ্কন করা হবে। সাধারণত টিউব লাইট দিয়ে ‘থাকা’ সাজানো হয়। কিন্তু এ বার ‘থাকা’র সাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলাবে আলোও। ওই ক্লাবের সদস্যদের দাবি, গত কয়েক বছরে থিমের রমরমায় কাটোয়াবাসীদের কাছে ‘থাকা’র আকর্ষণ অনেকটাই কমেছে। ‘থাকা’ দেখতে ভিড়ও জমে না। কিন্তু এই নতুন ‘থাকা’ অনেক দর্শককেই টানবে বলে তাঁদের আশা। ক্লাবের সদস্য রাজু দাস, কৌশিক দে-দের দাবি, “কার্তিক লড়াইয়ে যে সব পুজো উদ্যোক্তারা যোগ দেয়, তাঁরা মণ্ডপ বা আলোকসজ্জার দিকে নজর দেয় না। কিন্ত সে দিক দিয়ে আমরাই এগিয়ে।” কাটোয়ার পশারিপট্টিও ‘থাকা’য় নতুনত্ব নিয়ে আসছে এ বছর। প্লাইউড দিয়ে ‘থাকা’ তৈরি করছেন গোয়ালপাড়ার নিত্যগোপাল গোস্বামী। |
এক দিকে থিম পুজো, আরেক দিকে বিশাল বিশাল মূর্তি গড়ে কার্তিক আরাধনার দাপটে থাকা তার নিজস্বতা হারাচ্ছিল বলে দাবি লোক গবেষকদের একাংশেরও। কাটোয়ার কার্তিক লড়াইয়ের ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে লেখালেখি করেন পুরকর্মী অপূর্ব লাহা। তাঁর কথায়, “আমি নিজেও কার্তিক পুজোর সঙ্গে জড়িত। ঐতিহ্যে বিশ্বাসী। কিন্তু যে ঐতিহ্য আকর্ষণ হারায় তাকে আঁকড়ে রাখার কোনও মানে হয় না।” কাটোয়ার বাসিন্দা কবি রাজকুমার রায়চৌধুরী বা বাচিক শিল্পী নন্দন সিংহের মতেও ‘থাকা’ তৈরি থেকে শুরু করে তার উপর পুতুল সাজানো, সবটাই শিল্প। ‘থাকা’র চেহারা বদলের সঙ্গে শিল্পের ছোঁয়াও বদলাবে কিনা, সে দিকে আমাদের নজর থাকবে।
সুতরাং, থিম ও ‘থাকা’র লড়াই ছেড়ে নজর এ বার নতুন থাকা ও পুরনো ‘থাকা’র লড়াইয়ে।
|