প্রকৃতি বিপর্যয় ঘটাবেই। ফিলিপিনস-এর টাইফুন সেটা আবার দেখিয়ে দিল।
আমরা কি কোনও দিন তৈরি হতে, তৈরি থাকতে শিখব না?
তুষার কাঞ্জিলাল |
পুজোর পরে কারও সঙ্গে দেখা হলেই একটা প্রশ্ন পুজোটা কেমন কাটালেন? আমার উত্তর: ঝড়ের সঙ্গে। সারা দিন টিভির সামনে বসে ঝড়ের গতিপ্রকৃতি প্রতি মুহূর্তে জানা ও বোঝার চেষ্টা করছিলাম। এ ধরনের ঝড় আমার খুব চেনা। তবে একটা ব্যাপারে এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা অনেক নিখুঁত ভাবে একটি ঘূর্ণিঝড়ের জন্মবৃত্তান্ত থেকে তার বিধ্বংসী রূপ তৈরি হওয়া এবং তার পর উপকূলবর্তী অঞ্চলকে ভেঙেচুরে সব কিছু তছনছ করে দিয়ে বিলীন হওয়া পর্যন্ত তথ্য জোগাতে পারেন। ফলে মোকাবিলার চেষ্টাটাও অনেক ভাল করে করা যায়।
ওড়িশা উপকূলে ‘পিলিন’ নামে যে সামুদ্রিক ঝড় যে-তাণ্ডব সৃষ্টি করেছে, তা স্বচক্ষে না দেখলেও অনেকটাই পুরোপুরি অনুমান করতে পারি। অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে এই ধরনের প্রচণ্ড ঝড়ের সময় কী কী ঘটনা ঘটে। পুজোর ক’টা দিন সেই সব দৃশ্য বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। শুরুতে আশঙ্কা ছিল, ঝড়টা সুন্দরবনেও আসতে পারে। আতঙ্কে ঘুম ভেঙে গেছে। এ বার আমি ওদের সঙ্গে নেই, তাই উদ্বেগটা অনেক বেশি। শেষ পর্যন্ত ঝড় ওড়িশার উপকূলে আছড়ে পড়েছে। তবে এ বার জেনে খুব ভাল লাগল যে, ওড়িশা সরকার ঝড় আছড়ে পড়ার আগেই কয়েক লক্ষ লোককে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে গিয়েছিল, তাই মৃত্যুর হার অনেক কম। কিন্তু প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে ক্ষতির পরিমাণ জানা দুঃসাধ্য। |
বিপর্যয়। পিলিন-এর পরে বালেশ্বর। ছবি: পি টি আই। |
এর পর? সাময়িক ত্রাণের জোয়ার বইবে। কোমরভাঙা মানুষগুলি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে, ভাত নেই, মাথার উপরে আশ্রয় নেই, ভবিষ্যতের সব আশাভরসা পাঁচ হাত জলের তলায়, গরু-বাছুর এখানে-ওখানে সর্বত্র মরে পড়ে আছে। তার পর ধীরে ধীরে জল নেমে যাবে। ছোটখাটো সাহায্যের ভগ্নাংশ সরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের চেষ্টায় তাদের কাছে হয়তো পৌঁছবে। সংবাদপত্র, সংবাদমাধ্যম দু-তিন দিন বিভিন্ন ভাবে প্রচার করে মানুষকে সব জানাবার চেষ্টা করবেন। তার পর ধীরে ধীরে, এক দিন যারা পাশে গিয়ে দাঁড়াবেন, তাঁরাও সরে আসতে থাকবেন। মানুষগুলি অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে ঝড়ের প্রতীক্ষায় দিন কাটাবেন।
এ বার একটু অন্য কথায় আসি। পৃথিবীর সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের দুই দেশের দু’টি ঝড়ের তথ্য এবং এই ধরনের সর্বনাশকে আটকাবার কী কী চেষ্টা করা হচ্ছে, তা নিয়ে দু-চার কথা।
২০০৫ সালে ২৯ অগস্ট আমেরিকায় নিউঅরলিয়নস এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে হারিকেন ক্যাটরিনা বয়ে গিয়েছিল। আর ২০০৯ সালের ২৫ মে আয়লা নামক একটি ঝড় সুন্দরবনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ক্যাটরিনার ঝড় ২০৪ কি.মি. গতিতে ২৯ অগস্ট সকাল ৬টা ১০-এ স্থলভাগকে আঘাত করে। আঘাত করার সময় প্রায় ১৫ ফুট উঁচু জলের ঢেউ সৃষ্টি হয়েছিল। ঝড়ের সময় মারা গিয়েছিলেন ১৫০৩ জন। ৭০০ জনের মতো মানুষের মৃত্যু হয়েছিল নিরাপদ আশ্রয় খোঁজার চেষ্টায়। ঝড়ের পরবর্তী নানান ধরনের অসুস্থতায় আরও প্রায় ৩০০ জনের মতো মানুষ মারা গিয়েছিল। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার।
ঝড়ের পরেই সেখানকার সরকার তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বার করার জন্য অন্তত আটটি বিভিন্ন ধরনের সমীক্ষা শুরু করানয়। প্রশ্নগুলি ছিল খুব সোজা। ক) কী ঘটেছিল, কেন ঘটেছিল এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের ধ্বংসলীলা প্রতিহত করার জন্য কী কী করা যেতে পারে। যে সংস্থাগুলিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তা দেখলে বোঝা যায় যে, একটা সার্বিক অভিযান এবং সমস্যাকে একেবারে মূলে গিয়ে বোঝার চেষ্টা। যাতে মানুষ, বিজ্ঞান এবং প্রকৌশলের সাহায্য নিয়ে যা করা সম্ভব সবটাই করবে। প্রচুর পরিমাণ অর্থ আমেরিকা সরকার খরচ করেছেন। যেমন ‘আই ই পি টি স্টাডি’ নামে একটা সমীক্ষার জন্য ২০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছিল। সংক্ষেপে বললে, এ ধরনের বিভিন্ন সমীক্ষা এবং পৃথিবীর প্রখ্যাত প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীদের যৌথ পরামর্শ নিয়ে কতকগুলি সিদ্ধান্ত স্থির করা হয়েছিল।
এই বিপর্যয়ের জন্য মূলত দায়ী প্রথমত বিপর্যয়ের প্রচণ্ড শক্তি। দ্বিতীয়ত, বন্যারোধে যে ব্যবস্থাগুলি ছিল, তার অক্ষমতা, স্থানীয় বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রকৌশলের ব্যর্থতা, কতকগুলি ভুল সিদ্ধান্ত, এবং নকশা, নির্মাণ, কাজের পরিচালনা ও সমগ্র ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণে ত্রুটি। তৃতীয়ত, গোটা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব, তা কী ভাবে, কোন পথে এই দানবটির সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে, তা চিহ্নিত করা। প্রতিরোধ ব্যবস্থা ব্যর্থ হওয়ার কারণগুলি কী কী, তা নির্ণয় করার উপরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। অনুসরণ করা হয়েছিল ‘মাইক্রোস্কোপিক স্টাডি উইথ ফরেনসিক অ্যাপ্রোচ’।
এর পরে আয়লার কথা। ২০০৯ সালে ৫ মে বেলা ২টোয় আয়লা আছড়ে পড়েছিল উপকূলবর্তী দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার একটা ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে। ঝড়ের গতি ছিল ঘণ্টায় ১২০ থেকে ১৪০ কিলোমিটার, জলের উচ্চতা বেড়ে গিয়েছিল ৩.৩ মিটার। এই ঝড়ের আঘাতে সমুদ্রের নিকটবর্তী ৬০০ কিলোমিটার বাঁধ পুরো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। অন্যান্য নদীবাঁধের ১৭৫ কিলোমিটার ভেঙে গিয়েছিল। প্রাণহানি তুলনামূলক ভাবে কম হয়েছে, কিন্তু ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনও নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। ক্যাটরিনার পরে মার্কিন সরকার গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলির উত্তর পাওয়ার জন্য বিভিন্নমুখী সমীক্ষা চালিয়েছিলেন। সেটা না করে ভারত সরকার এই ধরনের প্রশ্নগুলিকে সামনে রেখেই একটিমাত্র টাস্ক ফোর্স গঠন করে।
নিউঅরলিয়নস-এ প্রায় নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কাজটা করা গিয়েছিল। আমাদের দেশে তা করা হয়নি। তার ফলে সরকারি-বেসরকারি সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও চার বছর বাদে আমরা প্রাথমিক কাজটাও শেষ করতে পারিনি। পিলিনের ঝড় যদি সামান্য একটু ঘুরে যেত, তা হলে সুন্দরবনের আয়লা-বিধ্বস্ত মানুষগুলিকে ঝড়ে উৎখাত হয়ে যেতে হত।
আমরা পারছি না কেন, তার অনেক কারণ। তার মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে বড় হল সুন্দরবনবাসীদের নিজেদেরই দূরদৃষ্টির অভাব, অসচেতনতা, সরকারি প্রচেষ্টার সঙ্গে সংহত ভাবে নিজেরাও চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। ক্যাটরিনা, আয়লা, পিলিন-এর মতো ঝড় ভবিষ্যতেও হবে। যেটা দরকার, তা হচ্ছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার এবং জনসাধারণের যৌথ উদ্যোগ ও তৎপরতা।
একটা উদাহরণ দিই। সুন্দরবনে আয়লার পর সাড়ে তিন বছর কেটে গিয়েছে। আয়লার পরে গঠিত টাস্ক ফোর্স যে ধরনের বাঁধ পুনর্নির্মাণের কথা বলেছিল এবং তিন বছরের মধ্যে তা বাস্তবায়িত করার কথা বলেছিল, তার ২৫ শতাংশ কাজও আমরা এই তিন বছরে করতে পারিনি, কারণ এই ধরনের বাঁধ তৈরি করতে গেলে জমি দরকার। রাজ্য সরকার মোটামুটি একটা ন্যায্য ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ দিয়েও জমি অধিগ্রহণ করতে পারছে না, নানা আইনি কারণে। গ্রামবাসীদের এগিয়ে এসে এই জমিটা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, না হলে চোখ বেঁধে বসে থাকাই একমাত্র উপায়। |