প্রবন্ধ ১...
শুধু সদিচ্ছায় মুশকিল আসান হবে না
লু নিয়ে রাজ্যে হাহাকার। আলু দুর্মূল্য। তাই দরিদ্র মানুষ থেকে মধ্যবিত্ত সবার পাতে টান পড়েছে। আলুর বিক্রেতারা সংকটে পড়েছেন। বাঙালির খাবারে আলুর গুরুত্ব অপরিসীম, শুক্তো থেকে ডাল, তরকারি থেকে ডালনা, ঝোল আর ঝাল, এমনকী বিরিয়ানিও, সবই আলু দিয়ে! বাঙালিকে যে আলুভাতে বলা হয়, যতই হোক তার তো ভিত্তি একটা আছে। আলু দুর্মূল্য হওয়া মানে বাঙালির পক্ষে শুধু অর্থনৈতিক বা ঔদরিক নয়, রীতিমত আত্মিক সংকট।
আলুর মধ্যে কীরকম যেন একটা শান্ত, নিরীহ, ভদ্র, এবং নির্ভরযোগ্য ব্যাপার আছে। তুলনায় অন্য সব তরকারির কত রঙ, কত বাহার, কত স্বাদ, কত বিচিত্র ভাবভঙ্গি। দাঁত থাকতে যেমন মানুষ দাঁতের মর্ম বোঝে না, সেই রকম আকাল না হলে আলুর গুণের কদর হয় না।
যদি ভাবেন আলুকে নিয়ে উচ্ছ্বাসটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে যাচ্ছে, তা হলে ইন্টারনেটে দেখে নিন, ২০০৮ সাল ছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের ঘোষিত আন্তর্জাতিক আলু বর্ষ (ইন্টারন্যাশনাল ইয়ার অব দ্য পটেটো)। বিশেষত অনুন্নত দেশে দরিদ্র মানুষের আবশ্যিক খাদ্যদ্রব্য হিসেবে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্যে, আলুকে গুপ্তধন (‘হিড্ন ট্রেজার’) আখ্যা দিয়ে সম্মান জানানো হয়। (সূত্র: http://www.fao.org/potato-2008/en/index.html) এখন, স্বীকার করতেই হবে, আপাতদৃষ্টিতে রাজ্য সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে পরিস্থিতি সামাল দিতে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন কৃষি বিপণন দফতরের ভার। যে কোনও সমস্যার গুরুত্ব উপলব্ধি করা এবং তার সমাধান বার করার রাজনৈতিক সদিচ্ছা একটা বড় ধাপ। কিন্তু কর্মপন্থা কী, সেটা নিয়ে ভাল করে না ভেবে ‘কিছু তো একটা করতে হবে’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়লে সমস্যার সমাধান হবে, না হিতে বিপরীত হবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
কোনও কিছুর দাম চড়চড় করে বাড়লে মনে হতে পারে, দামটার ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দিলেই সমস্যা মিটে যাবে। কিন্তু এতে উপলক্ষণের প্রশমন হবে মাত্র, আসল সমস্যার সমাধান তো হবেই না, বরং উল্টো ফল হবে। খুচরো বিক্রেতারা যে দামে আড়তদারদের কাছে কিনেছেন, তার থেকে কম দামে বিক্রি করলে তাঁদের ক্ষতি হবে, জীবনধারণ কঠিন হবে, ফলে কেন তাঁরা এতে রাজি হবেন? মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিরুদ্ধে যেমন যাওয়া যায় না, সেই রকম হুকুম করে বা হম্বিতম্বি করে চাহিদা ও জোগানের লৌহকঠিন নিয়মের ঊর্ধ্বে যাওয়া যায় না। যে কোনও পণ্যের কোনও কারণে জোগান কমলে বা উৎপাদনের খরচ বাড়লে, বাজারে দাম বাড়বে। সেখানে জোর করে বাজার দরের থেকে কম দাম বেঁধে দিলে, জোগান কমবে। সেটা আটকাতে আড়তদারের কাছে ১৭ টাকা কেজি দিয়ে কেনা আলু পুলিশ এসে যদি খুচরো বাজারে ১৩-১৫ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য করে, তা হলে তার পরিণামে অনেকগুলো সমস্যা।
প্রথমত, খুচরো বিক্রেতাদের ওপর এই ধরনের জোর-জবরদস্তি ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিপজ্জনক রকমের হস্তক্ষেপ। যে সরকার শিল্পের জন্যে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে এতটা নীতিনিষ্ঠ অবস্থান নিয়েছে যে, কৃষকের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাঁর জমি নেওয়া যাবে না, সেই সরকার কী করে আলু অধিগ্রহণের পক্ষে হতে পারে? দুটো জায়গাতেই যুক্তিটা তো এক: আমি কৃষক হলে দামে না পোষালে আমি আমার জমি বিক্রি করব না, আমি খুচরো বিক্রেতা হলে, খরচে না পোষালে আমি আলু বিক্রি করব না, সরকার আমার ওপর জবরদস্তি করবে কেন, দাম বেঁধে দেবে কেন? কোনও শ্রমজীবীকে মজুরিতে না পোষানো সত্ত্বেও শ্রম জোগাতে বাধ্য করা কি আমরা সমর্থন করতাম?
দ্বিতীয়ত, যাঁদের সুবিধার্থে এই হস্তক্ষেপ, অর্থাৎ ক্রেতারা, তাঁদেরও কোনও লাভ হচ্ছে না। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, আগে কয়েক দিন মানুষ ১৫-১৬ টাকায় বাজার থেকে আলু কিনছিলেন, কিন্তু সরকার ১৩ টাকায় দাম নিয়ন্ত্রণ করে দেওয়ায় বাজার থেকে আলু উধাও, অথবা পচা, পুরনো আলু পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি দরে যে আলু আসছে, তা চাহিদার তুলনায় নেহাতই নগণ্য, আবার কোথাও ক্রেতারা এর দেড় থেকে তিন গুণ দামে আলু কিনছেন। সংবাদপত্রেই পড়া গেল, এক বাজারে পুলিশ ১৫ টাকা দরে আলু বিক্রি করাচ্ছে, আবার তার পাশের এক বাজারেই আলু বিক্রি হচ্ছে ১৮ টাকায়, পুলিশ থাকলে জ্যোতি আলুর দর ১৩ টাকা, সরে গেলেই ২০ টাকা। ঢালু জমিতে জল গড়িয়ে নামবে, এক জায়গায় ঠেকা দিলে বেঁকে অন্য জায়গা দিয়ে নামবে। সেই রকম, আলুর আকাল হলে দাম বাড়বে, সেটা জোর করে এক জায়গায় আটকাতে গেলে, জোগান পিছলে গিয়ে অন্য জায়গায় হয় বেশি দামে বিক্রি হবে, না হলে উধাও হয়ে যাবে।
তৃতীয়ত, এক বার কোনও খুচরো বিক্রেতার কাছ থেকে জোর করে কম দামে আলু কেনা যেতে পারে, কিন্তু বার বার তা করা যাবে না; তিনি আলু বেচা বন্ধ করে দেবেন। তাই নৈতিকতার কথা যদি বাদও দিই, এই নীতি বাস্তবসম্মত নয়। জোর জবরদস্তি করলে জোগান কমবে বা বন্ধ হয়ে যাবে। কৃষকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে বামফ্রন্টের শিল্পায়নের পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়েছে, বর্তমান সরকার জোর করে বাস বা ট্রেন ভাড়া বাড়া রুখতে গিয়ে বাসের সংখ্যা কমে গেছে, এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবে কী করে?
তাই, সারা দিন ধরে দেয়াল দুহাত দিয়ে ঠেললে বা ফুটো পাত্রে জল আটকাবার চেষ্টা করলে যেমন অনেক পরিশ্রম হয় কিন্তু কাজের কাজ হয় না, সেই রকম মুখ্যমন্ত্রী, সরকার, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের বাজারে বাজারে ঘুরে আলুর দাম রোখার চেষ্টার মধ্যে সদিচ্ছা এবং পরিশ্রম থাকলেও, মূল উদ্দেশ্যের সিদ্ধির কোনও সম্ভাবনাই নেই।
এ বার এই চাহিদা-জোগানের সহজ সরল গল্পের একটু বাইরে যেতে হবে, কারণ আলু হিমঘরে মজুত করে রাখা যায়, এবং ক্রেতা আর উৎপাদকের মধ্যে খুচরো বিক্রেতাদের ছেড়ে আড়তদার এবং ব্যবসায়ীদের ভূমিকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। খুচরো বাজারে ক্রেতা আলুর যে দাম দেন, তার খুব অল্পই একটা অংশ আলুর চাষি বা খুচরো বিক্রেতারা পান। অধিকাংশই যায় আলুর ব্যবসায়ী (যাঁদের ফড়িয়া বলা হয়) এবং আড়তদারের কাছে। আলু উৎপাদনের পর্যায় থেকে উপভোক্তার রান্নাঘরে যাওয়ার মধ্যে অনেকগুলো ধাপ আছে, যাতে তার মূল্য যুক্ত (ভ্যালু অ্যাডেড) হয়, তাই ফড়িয়া এবং আড়তদারের প্রয়োজনীয় ভূমিকা নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সেটা ধরেও একটা বড় অঙ্কের লাভ যে মধ্যবর্তী এই শ্রেণির কাছে যায়, তা অনস্বীকার্য। তা ছাড়া আলুর বাজারদরের ওঠানামার ক্ষেত্রে ফাটকাবাজির একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। যখন কোনও বাহ্যিক কারণে চাহিদা ও জোগানের অসামঞ্জস্য হয়, যেমন এই ক্ষেত্রে অত্যধিক বৃষ্টির জন্যে হয়েছে, তখন খুচরো বাজারে দাম বাড়তে থাকে, এবং আরও বাড়বে এই আশায় ফাটকাবাজির কারণে বাজার থেকে আলু উধাও হয়ে যায়।
এই মুহূর্তে খুচরো বাজারে আলু দুষ্প্রাপ্য হলেও, হিমঘরে কিন্তু প্রচুর আলু মজুত আছে। কোনও কিছুর দাম যখন বাড়ছে, পাঠ্যবইয়ের অর্থনীতির যুক্তি বলে, তার জোগান তখন বাড়বে এবং চাহিদা কমবে। বাস্তবে কিন্তু এটাই একমাত্র চালিকা শক্তি নয়, আড়তদার এবং ফাটকাবাজেরা ভবিষ্যতে আরও বেশি লাভের আশায় সেই পণ্য মজুত করে রাখবেন, তাই স্বল্পমেয়াদে তার দাম আরও বাড়বে এবং মধ্যবর্তী ব্যবসায়ীরা কোনও কারণে জোগানের অভাব হলে তার থেকে লাভ করবেন। বাস্তব ঘটনাও তাই। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ১৬ লক্ষ মেট্রিক টন আলু হিমঘরে মজুত আছে, যা চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট। তাই সরকারি হস্তক্ষেপের লক্ষ্য হওয়া উচিত খুচরো ব্যবসায়ী নয়, আড়তদার। প্রশাসন যে এই ব্যাপারে অবহিত নন তা নয়, কিন্তু এর একটা রাজনৈতিক দিকও রয়েছে। যতই হোক, বড় আড়তদার, ফড়িয়া এবং হিমঘরের মালিকেরা রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবশালী।
তা হলে কী করণীয়? স্বল্পমেয়াদে সরকারের তরফে হিমঘর থেকে আলুর জোগান বাড়ানোর চেষ্টা করা দরকার। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। আলুর ব্যবসায়ীরা নানা ভাবে এটা আটকাবার চেষ্টা করবেন, কারণ দাম কমলে তাঁদের লাভ কমবে। তা হলেও, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ হিমঘর আইন অনুযায়ী হিমঘরের মালিকদের মজুত আলু ছেড়ে দিতে হবে। তাই নিকট ভবিষ্যতে বাজারে এই মজুত করে রাখা আলুর জোগান এমনিই আসবে এবং তাতে দাম পড়তে বাধ্য।
দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজতে হলে, আলুর বাজারে ব্যবসায়ী এবং আড়তদারের যে একচেটিয়া ক্ষমতা আছে তা কমাবার চেষ্টা করতে হবে। চাষিদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল তিনটে: এক, ঋণের অভাব; দুই, কোন বাজারে কী দাম, সেই বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য তাঁর নাগালে থাকে না; তিন, খুচরো বাজার তাঁর পক্ষে যথেষ্ট অধিগম্য নয়। এই সব দুর্বলতার কারণেই ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের এত রমরমা। বিপণনের উদ্দেশ্যে সংগঠিত চাষিদের সমবায়, চুক্তি চাষ, এবং কৃষিজাত পণ্যের খুচরো বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বহিরাগত প্রতিযোগিতা বাড়ালে চাষিদের লাভ হবে, আখেরে ক্রেতাদেরও লাভ হবে। কিন্তু, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হবে, তাঁরা ও তাঁদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকরা তা সহজে মেনে নেবেন না। আমরা গরম গরম পুঁজিবাদ-বিরোধী স্লোগান শুনব। স্বল্পপরিসরের এই লেখায় এই সমস্যার সম্ভাব্য সমাধানের গভীরে ঢোকা সম্ভব হল না। ভবিষ্যতে এই নিয়ে আরও আলোচনা করার ইচ্ছে রইল।

লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এ অর্থনীতির শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.