সম্পাদকীয় ২...
শরীর ও মন
দুইয়ের মাঝখানে একটি ব্যবধানবাদী শব্দ বসাইয়া দিবার অভ্যাস প্রাচীন। বিশেষত, ভারতে। শরীর মন অপেক্ষা স্থূল। শরীর বাহিরের, মন ভিতরের। শরীর বস্তু, মন ভাব। শরীর পার্থিব, মন অপার্থিব। শরীর মন্দ, মন ভাল। এই ভেদরেখা কতটা যুক্তিসংগত? বুঝিতে অসুবিধা হয় না, এই বিভেদ গড়িয়া তুলিবার পিছনে পুরানো ভারতের দুই ভিন্ন দর্শনপন্থা কাজ করিয়া গিয়াছে। এক দিকে বস্তুবাদীর দল। তাঁহারা মনে করেন, যাহা ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষ করিতেছি, তাহাই সত্য। শরীর সত্য। অন্য দিকে ভাববাদীরা। তাঁহারা মনে করিতেন, এই আপাত-প্রত্যক্ষ জগৎ মায়া, মিথ্যা, ভ্রম। আজ আছে কাল নাই। শরীর নশ্বর, অচিরেই মিলাইয়া যাইবে। আর আত্মা? আগুন তাহাকে পুড়াইতে পারে না, তরবারি তাহাকে ছেদন করিতে অক্ষম। সে শাশ্বত। তাঁহারা যাহাকে আত্মা বলিতেন, তাহার সহিত মন-এর তফাত আছে, কিন্তু লোকশ্রুতিতে এই দুই পথই ক্রমে শরীর আর মনের বিভাজনে পরিণত হইয়াছে। স্থূল শরীরকে অস্বীকার করা যাইতেছে না, অথচ তাহার প্রতি বিচিত্র এক ‘ঘৃণা’ ও ‘পাপবোধ’ কাজ করিয়া চলিতেছে।
এই ঘৃণা আর পাপবোধ শুধু ব্যক্তিমানুষের মনে জমিয়া থাকে না, সামাজিকতায় নানা ভাবে প্রকাশিত হয়। যৌনকর্মীদের সম্বন্ধে ভারতীয় সমাজের একাংশ বিশেষ ‘ঘৃণা’ পোষণ করেন। তাঁহাদের মনহীন উসকানিপ্রদায়ী সুদৃশ্য শরীরমাত্র মনে করিতেই অভ্যস্ত এই সমাজ। শরীরের গণ্ডিতে সীমিত না রাখিয়া সামগ্রিক মানুষ হিসাবে তাঁহাদের দেখিতে সে নারাজ। যৌনকর্মীদের যে মন আছে, স্বাভাবিক নাগরিক জীবনযাপনের অধিকার আছে, এ কথা সামাজিক মানুষ কিছুতেই স্বীকার করিতে চাহেন না। আশার কথা, ইদানীং কিছু পরিবর্তনের সংকেত মিলিতেছে। যৌনকর্মীদের জন্য সংগঠন গড়িয়া উঠিয়াছে, তাঁহাদের সন্তানদের শিক্ষার অধিকার গুরুত্ব পাইতেছে। সমাজের চোখ খানিক খানিক বদলাইতেছে। যে যৌনকর্মীরা বয়সে প্রবীণ হইয়াছেন, তাঁহাদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার আবাসের ব্যবস্থা করিতে উদ্যোগী হইয়াছে। দেহপট সনে যৌনকর্মীরা যাহাতে সকলই না হারান, সেই উদ্দেশ্যে মানবিক নিরাপত্তা প্রদানের এই উদ্যোগ।
এই উদ্যোগ এবং তাহার পশ্চাদ্বর্তী মানসিকতাটি শরীর ও মনের সম্পর্ক বিষয়ে নূতন ভাবনার খোরাক দেয়। মনে রাখা দরকার, শরীরের মন আছে, মনের শরীর। এই দুইয়ের মধ্যে বিভেদ ঘটাইলে পুরো মানুষকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। এই বিষয়ে পুরানো ভারত হইতে বিস্তর শিখিবার আছে। সেখানে তো কেবল শরীর আর আত্মার ভেদ দেখানো হইত না, দুইয়ের সম্মিলন দেখাইবার দৃষ্টিও ছিল। শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটক এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়। এই নাটকে বসন্তসেনা গণিকা। কিন্তু বসন্তসেনার শরীর ও মন দুইয়ের সমবায় এখানে দেখানো হইয়াছে। শ্রেষ্ঠী চারুদত্তকে ভালবাসেন বসন্তসেনা। এই চারুদত্তের সংকটে বসন্তসেনা তাঁহার সমস্ত গহনা সমর্পণ করিয়াছেন। ইহা শরীরের সম্পর্ক নহে, মনের সম্পর্ক। নাট্যকার তাহাকে মর্যাদা দিয়াছেন। যে দেশে বসন্তসেনাকে লইয়া নাটক রচিত হইত, সেই দেশে যৌনকর্মীদের মানুষের অধিকার দিতে দ্বিধা থাকিবার কথা নয়। এই দ্বিধার মূলে আছে শরীর-মনের ‘দ্বিধা’র বোধ। তাহা দূর করা জরুরি। সমাজকে যথার্থ আধুনিকতায় দীক্ষিত হইতে চাহিলে বুঝিতে হইবে, শরীর আর মনের ভেদ করা অনুচিত। এই দুই মিলাইয়া সবার উপরে মানুষ সত্য।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.