জন্মসূত্রে পাকিস্তানি, এমন এক ঐতিহাসিক এক বার ভারত ও পাকিস্তানের তুলনা টানিয়া বলিয়াছিলেন, সংবিধান-মতে যতই পার্থক্য থাকুক, দুই দেশের সমাজ ও রাজনীতির মধ্যে বিশেষ তফাত নাই: ধর্মের যে অন্ধ রূপ, তাহা সীমান্তের দুই দিকেই মনুষ্যজীবন ও রাষ্ট্রজীবনকে প্রভাবিত করে। তাঁহার এই মত সে দিন কম আক্রান্ত হয় নাই। গণতন্ত্র ও অ-গণতন্ত্রের মধ্যে ধর্মান্ধ মূল্যবোধ একই ভাবে ক্রিয়াশীল, এ কথা মানিয়া লওয়া সহজ ঠেকে নাই। অথচ আপাত ভাবে আপত্তিকর হইলেও, এবং বয়ানে কিছু আতিশয্য থাকিলেও, বক্তব্যটির সারমর্ম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের প্রায় সর্বত্র, প্রায় প্রত্যহ, কিছু না কিছু ঘটনা চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দেয় যে, এ দেশের ‘গণ’তন্ত্র আসলে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের তন্ত্র। মুম্বই-এ সম্প্রতি ফ্ল্যাট বিক্রির বিজ্ঞাপনে যে ভাবে জাঁকাইয়া ‘কোনও মুসলিম নয়’ দাবি শোভা পাইল, তাহা যতই আলোড়ন তুলুক, প্রগতিবাদীদের যতই শিহরিত করুক, ধর্মনিরপেক্ষতার খাতিরে আদালতে যতই মামলা ঠোকা হউক, ইহাকে কোনও মতেই ‘ব্যতিক্রমী ঘটনা’ বলা যাইতেছে না। ভারতের মাটিতে ইহাই সাধারণ দস্তুর। বরং ‘মুসলিম অঞ্চল’ বলিয়া পরিচিত এলাকার বাহিরে ভারতীয় মুসলিমরা যদি বিনাপ্রশ্নে বিনা-ভ্রুকুঞ্চনে ফ্ল্যাটে বসবাসের স্বীকৃতি পান, তাহাই ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসাবে, ‘সংবাদ’ হিসাবে গণ্য হইবার দাবি রাখে।
অবশ্য, ভাবিয়া দেখিলে, এক হিসাবে ইহাকে ব্যতিক্রমী বলা যাইতেও পারে। বিজ্ঞাপনে প্রকাশ্য অক্ষরে ‘নো মুসলিমস’ লেখা দেশের আইনের বিরুদ্ধে যায়। তাহা বোধহয় এই বিশেষ বিজ্ঞাপনদাতা তাড়াহুড়ার বশে ভাবিয়া দেখেন নাই। সেখানেই ইহার ব্যতিক্রম। নতুবা একই কাজ তো অনেক ফ্ল্যাট-বিক্রেতাই করিতেছেন, কেবল আর একটু সতর্ক ভাবে, মুদ্রিত শব্দের ফাঁদের বাহিরে থাকিয়া। মুসলিম স্পর্শ-গন্ধ আটকাইবার পদ্ধতিটি সাধারণত এ দেশে লিখিত-পড়িত হয় না, মৌখিক আদানপ্রদানেই সীমাবদ্ধ থাকে, কিংবা শরীরী ভাষায় বুঝাইয়া দেওয়া হয়। সংবিধান-মতে দেশটি যে ধর্মনিরপেক্ষ, এবং সে জন্য আইন-আদালত যে কতগুলি বাহ্যিক হিসাব মানিয়া চলিতে বাধ্য, এটুকু সরকারি ‘অসুবিধা’ মানিয়া লইয়া তাবৎ সমাজ অ-সরকারি ভাবে আরাম করিয়া সাম্প্রদায়িক অন্ধতা চর্চা করিয়া থাকে। মুম্বইয়ের মতো ‘কসমোপলিটান’ মহানগরে শাবানা আজমি হইতে এমরান হাশমি: বিভিন্ন প্রজন্মের খ্যাতনামা চলচ্চিত্র-তারকারা বাড়ি কিনিবার সময়ে মুসলিম বলিয়া প্রত্যাখ্যাত হইয়াছেন। তাঁহাদেরও এই হাল হইলে সাধারণ মুসলিমরা মুম্বই-মহারাষ্ট্র-ভারতে কী ভাবে বাঁচেন, তাহা বুঝাই যায়।
অন্য শহর বা প্রদেশ বিষয়ে কোনও অপ্রীতিকর তথ্য জানিলে কলিকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের নাক-উঁচু করিবার প্রবণতাটি আজন্ম। কিন্তু এই একটি বিষয়ে কলিকাতার মাথা হেঁট ও নাসিকা নিচু রাখাই বিধেয়। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের, এবং কলিকাতা আনন্দনগরীর আমূল লজ্জা যে, মুসলিম নাগরিকরা নিয়মিত ভাবে শহরের কেন্দ্রীয় অঞ্চলগুলিতে বাড়ি ভাড়া করিতে বা কিনিতে প্রত্যাখ্যাত হন বা প্রভূত অপ্রীতির ধাক্কা সামলাইয়া সফল হন। বাসস্থানের সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সর্ব ক্ষেত্রেই তাঁহারা ‘গেটো’-বাস্তবের শিকার, এবং/সুতরাং পশ্চাৎপরতায় নিমজ্জিত। ইহা শিথিল মন্তব্য নহে, গবেষণা দ্বারা সমর্থিত, সাচার কমিটির মতো সরকারি নথিতে স্বীকৃত। অবশ্য, গেটো-বাস্তবের কথা উঠিলে বলিতে হয়, কেবল সংখ্যালঘুরা নহেন, সংখ্যাগুরুরাও তাঁহাদের ‘অপর’দের বহির্ভূত করিয়া নিজেদের ‘গেটো’-জীবন তৈরি করিয়া লইয়াছেন। গণতন্ত্র যে রাজনীতিমাত্র নহে, একটি মানসিকতাও, তাহা মনে রাখিলে গোড়ায় আলোচিত মতটি উপেক্ষা করিবার উপায় থাকে না। |