সুযোগসাম্য, সক্ষমতা ইত্যাদি ধারণাগুলো কী ভাবে বাস্তবে উঠে আসে, সেই অভিজ্ঞতা লিখছেন
শুভ্রা দাস |
চৌবাচ্চাতলায় এক কাঁড়ি বাসন। মাজতে মাজতে দোলে ও গায়, ‘তু মেরি আগল বগল হ্যায়’। সুর চড়ে, হাত চলে দ্রুত। সে বাবলু মুর্মু, সাঁওতাল। বাড়ি অসমের কোকরাঝাড় জেলার শ্রীরামপুরে। ১৮৫৫’র সাঁওতাল অভ্যুত্থানের পর পর ব্রিটিশ শাসকরা বহু সংখ্যায় সাঁওতালদের দুমকা, সাহেবগঞ্জ, পাকুড় থেকে নিয়ে গিয়ে বসত গড়ায় কোকরাঝাড়ে। তাঁদের বংশধর বাবলু, যার মাতা-পিতা, স্বজনরা ১৯৯০-এর দশকে ছিন্নভিন্ন হয়েও টিকে গেছেন (কোকরাঝাড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের হাতে অন্তত দশ হাজার সাঁওতালের মৃত্যু হয়, লক্ষখানেক লোক বহু বছর শরণার্থী হয়ে কাটান)। বাবলুর বাবা মজুর, তার মা অন্য এক জনের সঙ্গে চলে গেছেন। তার বয়স মেরেকেটে দশ। ইস্কুলে ভর্তি হয়েছিল, ছেড়েও দিয়েছিল। দিদিমণি খুব মারতেন। তিনি কী বলতেন তা বাবলু বুঝত না, বাবলুর কথা তাঁর বোধগম্য হত না।
কিছু দিন এদিক ওদিক করার পর সে এখানে এসেছে। জায়গাটা জলপাইগুড়ি জেলার বারোবিসা। জাতীয় সড়কের পাশে এক লাইন হোটেলে কাজ করে তার বড় ভাই, সে তাকে নিয়ে এসেছে। বাবলুকে দেখে মনে হয় সে মহানন্দে আছে। কাজ করছে, খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে, টিভি থেকে গানের কলি তুলে নিচ্ছে! |
বাবলুর কথা ভাবতে ভাবতে পৌঁছই একটু দূরে চ্যাংমারি ধামে। দেখা হয় অমৃতার সঙ্গে। অমৃতা বারা, ওরাওঁ আদিবাসী সম্প্রদায়ের। ওরাওঁরা এখানে এসেছিলেন ঝাড়খণ্ডের অন্য এক প্রান্ত, রাঁচি, লোহারদাগা, গুমলা এলাকা থেকে। উত্তরবঙ্গের চা বাগানের যে বিপুল বৈভব, তার গঠনে এঁদের বর্ষ-বর্ষব্যাপী শ্রমের অংশ অনেক।
অমৃতারও মুখে অনাবিল হাসি। হাসতে হাসতে বসার জায়গা করে দিল, হাসতে হাসতে চা ফুটিয়ে আনল, কথা বলতে বলতে গ্রামপ্রান্ত পর্যন্ত এসে বিদায় জানিয়ে গেল।
সে ভাত রাঁধে, বন থেকে কাঠ বয়ে আনে, ধান পোঁতে, ধান কাটে। কিন্তু, ছোট স্কুলবেলায় তুলনায় সদয় শিক্ষক পেয়েছিল বলে সে আজ সাইকেল চালিয়ে ইস্কুলে যায়, কলেজে যেতে চায়। আবার সেই ইস্কুলের কথাতেই তার মুখে বিষণ্ণতা নেমে আসে, যা তার নৈসর্গিক হাসির চাদরেও ঢাকা পড়ে না। কেননা, সে এ বছর উচ্চ মাধ্যমিকে ফেল করে গেছে। তার মা-বাবা টিউশানির টাকা জোগাড় করতে পারেনি, বাড়িতে বিজলি নেই, রেশন দোকান থেকে যেটুকু কেরোসিন পাওয়া যায়, তাতে সারা সপ্তাহ চলে না, সব সন্ধ্যায় পড়তে বসতে পারে না। মা-বাবা দিনমজুর, সব বই কিনে ওঠা হয়নি।
তবু সে আগামী বছর আবার উচ্চ মাধ্যমিক দিতে চায়। পড়তে পারার দামটা সে জেনেছে। ইস্কুলে যেতে পেরেছে বলেই ঋতুকালে ছেঁড়া ন্যাকড়া ব্যবহার অস্বাস্থ্যকর বলে জেনেছে। ‘অনেক কষ্টে কিনতে হয়, তবু আমি স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করি।’ (পঞ্চায়েত দফতর যে শস্তায় স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল, সেটা কোথায় গেল?) সে জানে, মাঠে শৌচকর্ম করলে নানান রোগ হয়, তারই চাপাচাপিতে বাড়িতে শৌচালয়ের প্রতিষ্ঠা। সে জানে, ‘আমাদের জন্য সুযোগ অনেক কম, যা করার নিজেদেরই করতে হবে। পড়াশুনো না শিখলে সেগুলো করব কী করে?’
ফেরার পথে আবার বাবলুর সঙ্গে দেখা। ছুটতে ছুটতে এল। আমাদের তার বেশ পছন্দ হয়েছিল, আমাদের এক জন তার সঙ্গে তার ভাষা সাঁওতালিতে কথা বলছিলেন বলে। তাকে প্রশ্ন করি, ‘আচ্ছা, যদি এমন কোনও স্কুল তাকে, যেখানে কেউ তোমাকে মারবে না, তোমার দিদিমণি তোমার কথা বুঝতে পারবেন, তা হলে তুমি স্কুলে যাবে?’ ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যার আধো অন্ধকারেও তার মুখে কেমন এক বিহ্বলতার আলো। চমক ভাঙে হোটেল মালিকের ডাকে, ‘বাবলুওয়া!’ সে চায়ের গেলাসগুলো চৌবাচ্চাতলায় নিয়ে যায়।
বাবলুর কথা, অমৃতার কথা মনের মধ্যে পাশাপাশি রেখে ভাবতে ভাবতে একটা বোধ আসে: জানার বোধ। উন্নয়ন তত্ত্বের পাঠ্যবইগুলোতে সুযোগসাম্য, সক্ষমতা ইত্যাদি যে ধারণাগুলো অধরা থেকে যেত, সেগুলো যেন ধরতে পারছি।
|
প্রতীচী ইনস্টিটিউটে গবেষক |