প্রশ্নের মুখে ‘মাঙ্কি উইমেন’-এর জীবনকাহিনি!
চলতি বছর মার্চে প্রকাশিত হওয়ার পর সাহিত্যের বাজারে হইচই ফেলে দিয়েছিল সাদা মুখো কাপুচিন বাঁদরের রাজত্বে একরত্তি এক ব্রিটিশ মেয়ের বেড়ে ওঠার কাহিনি ‘দ্য গার্ল উইথ নো নেম।’ এমনকী ‘বেস্ট সেলার’ খেতাবও জিতেছিল বইটি। এখন প্রশ্ন উঠছে সেই গল্পের সত্যতা নিয়েই।
পঞ্চাশের দশকে কলম্বিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় ঘরছাড়া হয়েছিল ‘মাঙ্কি উইমেন’ ওরফে ম্যারিনা চ্যাপম্যানের পরিবারটিও । অপহরণকারীদের খপ্পরে পড়েছিল বছর পাঁচেকের ম্যারিনা। অপহরণের পর পালানোর সময় পুলিশের তাড়া খেয়ে ম্যারিনাকে কলম্বিয়ার জঙ্গলেই ফেলে চলে যায় দুষ্কৃতীরা। ঘুরতে ঘুরতে পশ্চিম ইয়র্কশায়ারের দুর্ভেদ্য বৃষ্টিঅরণ্যে ঢুকে পড়েন ম্যারিনা। জঙ্গলেই ছোট্ট ম্যারিনার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিল এক বৃদ্ধ কাপুচিন বাঁদর, ম্যারিনার ‘গ্র্যান্ড পা।’ কাপুচিন বাঁদরের রাজত্বে থাকতেই তাদের আদব কায়দা শিখতে থাকেন ম্যারিনা।
পাঁচ-পাঁচটা বছর জঙ্গলে কাটানোর পর অবশেষে কাঠুড়িয়াদের হাতে পড়েন ‘মাঙ্কি উইমেন।’ তারাই কলম্বিয়ার উত্তর-পূর্বে কুকুটায় এক পরিবারের কাছে বিক্রি করে দেয় ম্যারিনাকে। সেখানেই দীর্ঘদিন ন্যানি হিসেবে কাজ করতেন তিনি। সেই পরিবারের সঙ্গেই ইংল্যান্ডে আসার পর স্বামী জন চ্যাপম্যানের সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। আজ ম্যারিনা ষাটোর্দ্ধ। দুই মেয়ে নিয়ে তাঁর ভরা সংসার। মেয়ে ভ্যানেসা জেমসের উৎসাহেই কাপুচিন বাঁদরের রাজত্বে ছেলেবেলা কাটানোর অভিজ্ঞতা ‘দ্য গার্ল উইথ নো নেম’ বইটির সাহায্যে প্রকাশ্যে আনেন তিনি। জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছয় ‘মাঙ্কি উইমেন।’ টারজান, মোগলির মতোই শিশুদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন। ‘দ্য গার্ল উইথ নো নেম’-কাহিনিটি অবলম্বনেই একটি তথ্যচিত্র তৈরির পরিকল্পনা করে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল। গল্পের সত্যতা যাচাই করে নিতে একটি বিশেষজ্ঞ দল নিয়োগ করা হয়। ম্যারিনার হাড়ের গঠন পরীক্ষা করে দেখা যায় ছয় থেকে দশ বছর বয়স পর্যন্ত অপুষ্টিতে ভুগেছেন তিনি। ম্যারিনার গল্প অনুযায়ী, জীবনের এই সময়টাই কাপুচিন বাঁদরের রাজত্বে কাটিয়েছিলেন তিনি। লাই ডিটেক্টর টেস্টেও ধরা পড়ে ম্যারিনা যা বলছেন তা পুরোটাই সত্যি। স্বামী ও দুই কন্যার পাশাপাশিই তাঁর স্মৃতিতে সমান ভাবে উজ্জ্বল বাঁদর পরিবার।
তা হলে ‘মাঙ্কি উইমেন’-এর গল্প নিয়ে প্রশ্ন কীসের?
সম্প্রতি প্রস্তাবিত তথ্যচিত্রটির শ্যুটিং করতে ম্যারিনাকে নিয়ে পশ্চিম ইয়র্কশায়ারের উদ্দেশে রওনা হয় ফিল্ম ক্রু। ঘন, স্যাঁতস্যাঁতে বৃষ্টি অরণ্যে ম্যারিনার অবাধ হাঁটাচলা ছবির পরিচালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়, ভুল বলেননি ম্যারিনা। ঘন জঙ্গলে একটানা হেঁটে সবাই যখন ক্লান্ত, তখন ম্যারিনা পাম গাছের ছাল ছিঁড়ে বসার জায়গা করে দিলেন। তড়তড়িয়ে উঠে গেলেন নারকেল গাছে, খালি মুখে নারকেল ছাড়িয়ে খেতে দিলেন সহযাত্রীদের।
দীর্ঘদিনের যাত্রা শেষে সকলে যখন কাপুচিন বাঁদরের ডেরায় পৌঁছলেন বিশ্বাসে চিড় ধরা শুরু ঠিক তখনই। যে ম্যারিনা কাপুচিন বাঁদরদের নিজের পরিবারের সদস্য বলে বর্ণনা করে এসেছেন এত দিন সেই ম্যারিনাই একটি বারও তাঁর ছেলেবেলার সঙ্গীদের কাছে গেলেন না। তাদের ছুঁয়ে দেখা তো দূরের কথা, ডেকে খাবার দিতেও পা কেঁপে উঠল তাঁর। ম্যারিনার শিষেও কোনও জবাব দিল না কাপুচিন বাঁদরেরা। ম্যারিনা বলছেন, যে কাপুচিন বাঁদর দল তাঁকে বড় করে তুলেছিল এরা তারা নয়।
বৃষ্টিঅরণ্যে ফিল্ম ক্রুর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা এখন দাবি করছেন ম্যারিনা আদতে ‘ফল্স মেমোরি সিনড্রোমের শিকার।’ ছোটবেলার কোনও অভিজ্ঞতা ভুলে থাকতেই মনে মনে এই গল্পের জন্ম দিয়েছেন তিনি। বাঁদরের রাজত্বে তাঁর বড় হয়ে ওঠার কাহিনি আর পাঁচটা রুপকথার গল্পের মতোই ভিত্তিহীন। ম্যারিনা এখনও বলে চলেছেন, “আমি জানি, আমি সত্যি বলছি।” |