অবশেষে বিকল্পের সন্ধান মিলল। তৈরি হল প্রকল্পের রূপরেখা, অর্থের সংস্থানও হয়েছে। তবে পরিকল্পনা কত দূর বাস্তবায়িত হবে, সে ব্যাপারে সংশয়ের একটা গেরোও রয়ে গিয়েছে। কারণ, সেই জমি।
বর্তমানে উত্তরবঙ্গ-দক্ষিণবঙ্গ সংযোগকারী মূল রাস্তা ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক। মাত্রাতিরিক্ত গাড়ির চাপে বহু জায়গায় তার বেহাল দশা। ৩৪ নম্বর এড়িয়ে যাতে আরও কম সময়ে উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গে পৌঁছনো যায়, সে জন্য নতুন পথের খোঁজ করছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। বছরখানেক ধরে নানান সমীক্ষা চালিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি চূড়ান্ত হয়েছে। নতুন যে সড়কপথে রাজ্যের উত্তর-দক্ষিণকে মেলাতে চাইছে পূর্ত দফতর, তার শুরু হবে বীরভূমের মোড়গ্রামে। শেষ পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া লাগোয়া মেছোগ্রামে, যেখান থেকে কিছুটা এগোলেই হলদিয়া বন্দর।
নতুন পথ যাবে কোথা দিয়ে?
পূর্ত-সূত্রের খবর, এটি ছুঁয়ে যাবে ছ’টি জেলা পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, হুগলি, বর্ধমান, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ। এক কর্তা বলেন, “উত্তরবঙ্গ থেকে এনএইচ-৩৪ ধরে মালদহ-মুর্শিদাবাদ-নদিয়া-উত্তর ২৪ পরগনা হয়ে কলকাতায় পৌঁছানো যায়, তেমন কলকাতা না-ছুঁয়েও এনএইচ-৬০ ধরে বীরভূম-বাঁকুড়া হয়ে উত্তরবঙ্গ থেকে পশ্চিম মেদিনীপুরে পৌঁছানো যায়। নতুন পথে এত ঘুরতে হবে না।” তাঁর দাবি, প্রস্তাবিত রাস্তা দিয়ে অনেক বেশি গাড়ি চলবে। এমনকী, উত্তরবঙ্গ থেকে হলদিয়া বন্দরমুখী মালবাহী লরিগুলোরও সময় বাঁচবে।
এবং প্রস্তাবিত ২৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তাটি বানাতে প্রাথমিক ভাবে খরচ ধরা হয়েছে তিন হাজার কোটি টাকা। এ জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক (এডিবি)-এর ঋণ মিলবে। এক পূর্ত-কর্তা জানিয়েছেন, সরকার এডিবি-র কাছে ওই ঋণ চেয়েছিল এক বছর আগে। প্রস্তাবটির সম্ভাব্যতা ও আর্থ-সামাজিক যথার্থতা খতিয়ে দেখার ভার এডিবি দিয়েছিল এক মার্কিন সংস্থাকে। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে এডিবি ঋণ জোগাতে রাজি হয়েছে। তার পরে, গত বুধবার এডিবি-র এক প্রতিনিধিদল নবান্নে এসে বৈঠক করেছেন পূর্ত-সচিব ইন্দিবর পাণ্ডে-সহ দফতরের ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে। নির্দিষ্ট সময়সীমা মেনে কী ভাবে দ্রুত প্রকল্প রূপায়ণ সম্ভব, মূলত তা নিয়েই বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বলে সরকারি সূত্রের খবর। |
আর সে প্রসঙ্গেই কপালে ভাঁজ পড়েছে রাজ্য প্রশাসনের কর্তাদের একাংশের। কেন?
কারণ হিসেবে রাজ্যের জমি-সমস্যার দিকে আঙুল তুলছেন ওঁরা। এই মহলের ব্যাখ্যা: সমীক্ষা-রিপোর্ট অনুযায়ী প্রস্তাবিত রাস্তাটি বানাতে ৯২৭ একর জমি লাগবে। অথচ যে সব এলাকা দিয়ে রাস্তা যাওয়ার কথা, তার ৫০ শতাংশের বেশি হল কৃষিজমি। বাকি অংশের ৩২% জুড়ে জনবসতি। উপরন্তু বেশ কিছু জায়গায় সরকারি জমি জবরদখল করে দোকান-বাড়ি গজিয়ে উঠেছে। জমিগুলি কী ভাবে অধিগ্রহণ করা যাবে, তা ভেবেই দুশ্চিন্তায় পড়েছেন পূর্ত-আধিকারিকদের অনেকে, যাঁদের আশঙ্কার মূলে সরকারের জমি-নীতি। প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, “জবরদস্তি জমি অধিগ্রহণ করা যাবে না এটাই বর্তমান সরকারের নীতি। আর তারই জন্য পাঁচটি রাজ্য-সড়ক সম্প্রসারণের পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না যে, চাষিদের বুঝিয়ে-সুজিয়ে কবে জমির দখল মিলবে। কিংবা আদৌ মিলবে কি না।”
অর্থাৎ, জমির সংস্থান এখনও অনিশ্চিত। এ দিকে এডিবি প্রকল্পের বিভিন্ন পর্যায়ের কাজ শেষ করার বিভিন্ন সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না-হলে ঋণের টাকা আটকে যেতে পারে। “তাই জমি-জটের জেরে কাজে বিলম্ব হলে পুরো উদ্যোগই ভেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে।” মন্তব্য করেছেন এক পূর্ত-আধিকারিক। প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি পরিকাঠামো নির্মাণে ‘প্রয়োজনভিত্তিক’ জমি অধিগ্রহণে সায় দিয়েছেন বলে প্রশাসন সূত্রে ইঙ্গিত মিলেছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এত তাড়াতাড়ি তার সুফল মেলার আশা করতে পারছেন না প্রশাসনিক-কর্তাদের সিংহভাগ।
বস্তুত জমির ফাঁসে সড়ক সংস্কার পরিকল্পনার পঞ্চত্বপ্রাপ্তির নজির পশ্চিমবঙ্গে মজুত। যেমন, কল্যাণী মোড় থেকে ডানকুনি পর্যন্ত দিল্লি রোড পুরোদস্তুর চার লেন করার পরিকল্পনা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে নবগঠিত ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল হাইওয়ে ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন।’ এক পূর্ত-কর্তার কথায়, “রাস্তাটি দিয়ে রোজ গড়ে পঁচিশ হাজার গাড়ি চলাচল করে। যানবাহনের চাপে তার যা অবস্থা, তাতে এখনই সম্প্রসারণ জরুরি। অথচ প্রয়োজনীয় জমি পাওয়া যাচ্ছে না। তাই আপাতত চন্দননগর থেকে ডানকুনি ২৩ কিলোমিটার চার লেন হবে। বাকি ৩২ কিলোমিটার দু’লেনই থাকবে।” কিন্তু গোটা রাস্তার শুধু একটা অংশ চওড়া হলে আদৌ কি লাভ হবে?
ইঞ্জিনিয়ারদেরই একাংশের দাবি, লাভ তো হবেই না, উল্টে চওড়া অংশের বিপুলসংখ্যক গাড়ি একসঙ্গে সরু অংশের দোরগোড়ায় এসে জট আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। একই ভাবে ভুগেছে ও ভুগছে চৌত্রিশ নম্বর। উত্তরের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের মূল সংযোগসূত্র হওয়া সত্ত্বেও সেটি চওড়া করা যায়নি। মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও এনএইচএআই তার সম্প্রসারণে হাত দিতে পারেনি। কেননা, জমি মেলেনি।
নতুন প্রকল্পের ভবিতব্য কী, সেটাই আপাতত দেখার।
|