শহরের নামোপাড়ায় হোটেল ম্যানেজার খুনের ঘটনায় ওই হোটেলের মালিক আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর ছেলে অনির্বাণকে গ্রেফতার করল পুলিশ। বুধবার রাতে পুরুলিয়া সদর থানার বাসস্ট্যান্ডের কাছে, রাস্তা থেকে তাঁদের গ্রেফতার করা হয় বলে পুলিশের দাবি। জেলা পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীর কুমার বলেন, “নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই তাঁদের ধরা হয়েছে।” ধৃতদের বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির করানো হলে বিচারক তাঁদের তিন দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন।
মঙ্গলবার গভীর রাতের কোনও এক সময়ে নামোপাড়ায় ‘হোটেল পিনাকী সদন’-এর ম্যানেজার ভাস্কর চট্টোপাধ্যায়কে গুলি করা হয়েছিল। প্রথমে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় সেখান থেকে তাঁকে ‘রেফার’ করে দেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বুধবার ভাস্করবাবুর মৃত্যু হয় বোকারো স্টিল জেনারেল হাসপাতালে। অভিযোগ, আশিসবাবুই গাড়িতে করে ভাস্করবাবুকে ওই দুই হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন।
ওই ঘটনার জেরে বুধবার সকালে হোটেলটিতে আগুন লাগিয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা। চলে ব্যাপক ভাঙচুর। বুধবার রাতেই ভাস্করবাবুর দেহ নিয়ে পুরুলিয়ায় ফেরেন তাঁর আত্মীয়েরা। পরে নিহতের দাদা ভৈরব চট্টোপাধ্যায় আশিস, অনির্বাণ-সহ চার জনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করেন। অন্য দুই অভিযুক্ত হলেন আশিসবাবুরই ভাই কল্যাণ ও রানা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই দু’জন অবশ্য এখনও অধরা। পুলিশ খুনের মামলা রুজু করেছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে খুন ও প্রমাণ লোপাটের চেষ্টার অভিযোগ আনার পাশাপাশি অস্ত্র আইনেও মামলা করা হয়েছে। এ দিন আদালতের বাইরে আশিসবাবুর কাছে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “এ নিয়ে আমি কিছু বলব না। যা বলার আমার আইনজীবী বলবেন।” তাঁর আইনজীবী অরূপ ভট্টাচার্যের অবশ্য দাবি, এ ব্যাপারে এখনও মক্কেলের সঙ্গে তাঁর কোনও কথাই হয়নি! তাই এখন তিনিও কিছু বলতে পারবেন না। |
বৃহস্পতিবারও পুরুলিয়া শহরে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল এই খুনের ঘটনাই। কেন খুন হতে হল এলাকায় ‘ভালমানুষ’ হিসাবে পরিচিত, বছর চুয়ান্নর ভাস্করবাবু ওরফে বুটনকে, সেই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে নামোপাড়ার বাসিন্দাদের মনে। বস্তুত, গোটা ঘটনা নিয়েই অনেক ধোঁয়াশা ও ধন্দ রয়েছে। হোটেলের ভিতরে ঠিক কী ঘটেছিল ওই রাতে, তা পুলিশ এখনও জানতে পারেনি। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দ্যুতিমান ভট্টাচার্যও বলেন, “বেশ কিছু প্রশ্ন উঠে এসেছে এই ঘটনাকে ঘিরে। এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেতে অভিযুক্তকে হেফাজতে নিয়ে জেরা করা হবে।” পুলিশ সূত্রের খবর, ভাস্করবাবুর গলায় গুলি করা হয়েছিল। ক্ষতস্থান থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। ময়না-তদন্তের রিপোর্ট পেলে মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট হবে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
নামোপাড়ার বাড়িতে বসে নিহতের বড় ছেলে বিশাল এ দিন জানান, মঙ্গলবার রাতে হোটেল থেকে কেউ এক জন তাঁকে ডেকে নিয়ে যান। বিশালের কথায়, “রাত তখন একটা হবে। এক জন এসে বলে, বাবা পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছেন। আমাকে সোজা হাসাপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। দেখি বাবা হাসপাতালের এমার্জেন্সির বাইরে একটা গাড়ির সিটে শুয়ে। গলার কাছে প্রচুর রক্ত। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল বাবা। কিন্তু কথা বলতে পারছিল না। আমি হাতের ইশারায় থামতে বলি। তখনও তো জানতাম না যে বাবাকে গলাতেই গুলি করা হয়েছে!” সেখানে আশিসবাবুও ছিলেন বলে বিশাল জানিয়েছেন। তাঁকে সঙ্গে নিয়েই আশিসবাবু গাড়িতে করে রওনা দেন বোকারোর উদ্দেশে।
নিহত এবং অভিযুক্ত আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, দু’জনেই নামোপাড়ার বাসিন্দা। ওই এলাকাতেই বাড়ি ভৈরববাবু এবং পুরুলিয়ার পুরপ্রধান, তৃণমূলের তারকেশ চট্টোপাধ্যায়ের। এ দিন ভৈরববাবু বলেন, “হোটেল থেকে আমাদের বাড়ির দূরত্ব মেরেকেটে একশো ফুট। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ভাইকে হাসাপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। অথচ একবারের জন্যও আমাদের জানানো হল না! এটা আমাদের অবাক করেছে।” তারকেশবাবুও বলেন, “আমার বাড়ির দরজাও হোটেলের থেকে শ’দেড়েক ফুটের বেশি নয়। পাড়ায় এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে। আমি জানতে পারি বুধবার সকালে।” ভৈরববাবুর আরও অভিযোগ, “হোটেলে আগুন লাগানো হয়েছিল প্রমাণ লোপাটের উদ্দেশ্যে। খবর পেয়েছি, ঘটনার পরে হোটেল ছেড়ে কর্মীরা পালিয়ে গিয়েছিল। শুধু অফিস ঘর আর রিসেপশনের সবটা পুড়েছে। বাকি সব ঠিক আছে। আমরা সদর দরজার কাছে রক্তের দাগ দেখতে পেয়েছি। পরে কেউ সেই দাগ ধুয়ে ফেলার চেষ্টাও করে। এ সব থেকেই নানা প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে।” |
ভৈরববাবু ও তারকেশবাবু, দু’জনেই বুধবার বোকারোয় গিয়েছিলেন ভাস্করবাবুর দেহ আনতে। ভৈরববাবুর দাবি, তাঁরা বোকারোর হাসপাতালে পৌঁছে দেখেন, ময়নাতদন্ত ছাড়াই ভাস্করবাবুর মৃতদেহ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন আশিসবাবু, তাঁর ছেলে অনির্বাণ এবং আশিসবাবুর দুই ভাই। সঙ্গে আরও কয়েক জন ছিলেন। সে জন্য কাগজপত্রও প্রায় তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ভৈরববাবুরা তখন প্রশ্ন তোলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে এক জনের মৃত্যু হওয়া সত্ত্বেও কী ভাবে ময়নাতদন্ত ছাড়াই দেহ ছাড়া হবে? পুরপ্রধান তারকেশবাবু বলেন, “তা ছাড়া, এক রাজ্যের হাসপাতাল মৃতদেহ ছেড়ে দিলে অন্য রাজ্যের হাসপাতালে সেই দেহের ময়নাতদন্ত হবে কি না, তা নিয়েও আমরা সন্দিহান ছিলাম। তাই আমরা দেহ নিতে অস্বীকার করে ময়নাতদন্ত ওখানেই করার দাবি তুলি। স্থানীয় পুলিশ অবশ্য এর পর সহযোগিতা করে।” ভৈরববাবুর আরও দাবি, পুলিশ ওই রাতে হোটেলে যে কর্মীরা ছিল, তাদের খুঁজে বের করুক। তাহলেই মঙ্গলবার রাতে কী ঘটেছিল, জানা যাবে।
বাবার সঙ্গে রাতে হোটেলে প্রায় দিনই থাকত নিহত ভাস্করবাবুর ছোট ছেলে বিক্রম। তার কথায়, “বাবাকে মাঝেমাঝেই পাড়ার লোকজন তাঁদের কোনও প্রয়োজনে ডেকে নিয়ে যেতেন। তখন বাবা আমাকে বলত, ‘তুই একটু হোটেলটা দেখবি’।” মঙ্গলবার রাতে অবশ্য বিক্রম বাবার সঙ্গে ছিল না। সে জানায়, পাড়ার শিব ঠাকুরের বিসর্জন ছিল। বিসর্জন সেরে ফিরতে একটু রাত হয়েছিল। তাই মা মঙ্গলবার রাতটা বাড়িতেই থাকতে বলেছিলেন। “হোটেলে গেলে বাবাকে হয়তো বাঁচাতে পারতাম”আক্ষেপ ঝরে পড়ে বিক্রমের গলায়।
|