সামান্য জমিতে চাষবাসে কতই বা রোজগার! মেয়েকে মাধ্যমিক কিংবা উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়িয়ে তাই অনেক বাবা-মা ভেবেছিলেন তাদের বিয়ে দিয়ে দেবেন। শেষ পর্যন্ত বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর ব্লকের এমন অনেক অভিভাবকের মত পাল্টাতে পারছে তাঁদের ঘরের মেয়েরাই। কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি টপকে সেই মেয়েদের কয়েকজন এখন স্বনির্ভর হয়ে উঠেছেন।
এই অসাধ্য সাধনে ওই দুঃস্থ মেধাবী ছাত্রীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ‘ফ্রিড’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। বইপত্র দিয়ে, বিনামূল্যে কোচিংয়ের ব্যবস্থা করা থেকে গ্রন্থাগারে সহায়ক পাঠ্যবই পড়ার সুযোগ করে দিয়ে ফ্রিডের কর্মীরা ওই মেয়েদের পড়াশোনার ইচ্ছার গতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন।
বিষ্ণুপুর ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম লায়েকবাঁধের গরিব ঘরের মেয়ে অপু ঘোষের জীবন পাল্টে দিয়েছে ওই সংস্থা। তাঁর বাবা ভজহরি ঘোষ ভেবেছিলেন, “সামান্য জমিতে চাষবাস করে বিশেষ আয় হয় না। তাই উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়িয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেব ভেবেছিলাম। তার আগেই ফ্রিডের কর্মীদের সঙ্গে মেয়ের যোগাযোগ হয়।” তাঁরাই অপুকে বইপত্র দিয়ে স্থানীয় রাধানগরে বিনামূল্যের কোচিং সেন্টারে পড়তে যেতে বলেন। সেখানে সংস্থার গ্রন্থাগার থেকে বই এনে পড়ার সুযোগও করে দেওয়া হয়। উচ্চমাধ্যমিকে ভাল ফল করে সেই অপু কলকাতার কলেজ থেকে বিএ পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃতে ৬৮ শতাংশ নম্বর নিয়ে এমএ পাশ করেছেন। এখন তিনি স্থানীয় ভড়া কলেজের আংশিক সময়ের শিক্ষিকা। ওই কোচিং সেন্টারেও তিনি পড়াতে যান।
|
অপুর গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে জন্তা গ্রামের মেয়ে মল্লিকা কুণ্ডু-র উঠে আসার ঘটনাও একই রকমের। তার বাবা বা মা প্রথাগত শিক্ষা পাননি। বিপিএল পরিবারের অপুর বাবা কালীপদ কুণ্ডু দিন মজুরের কাজ করেন। কুঁড়ে ঘরে লণ্ঠনের আলোয় মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েই তার পড়াশোনা থেমে যেতে বসেছিল। ফ্রিডের কো-অডিনেটর কাজল শর্মা খবর নিয়ে কালীপদবাবুকে বুঝিয়ে অপুকে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি করান। সেই অপু উচ্চমাধ্যমিকে ৮১.৪ শতাংশ নম্বর পান। কলকাতার কলেজে হোস্টেলে রেখে তাঁর পড়াশোনার ব্যবস্থা করে ফ্রিড। বিএ তে ৬৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে অপু এখন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনে এমএ পড়ছেন।
বুধবার রাধানগরে ফ্রিডের এক অনুষ্ঠানে মল্লিকা, অপুদের সঙ্গে এসেছিল এলাকার আরও ১০০ দুঃস্থ মেধাবী ছাত্রী। তাঁদের উৎসাহ দিয়ে গেলেন রাজ্যের মন্ত্রী শ্যামাপদ মুখোপাধ্যায়। ছিলেন রাধানগর হাইস্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক শঙ্করীপ্রসাদ বিশ্বাসও। তিনি এখন ওই কোচিং সেন্টারের শিক্ষক। বললেন, “মাধ্যমিকের পরে এলাকার যে সব দুঃস্থ-মেধাবী ছাত্রীদের পড়ার সামর্থ থাকে না, ২০০৬ সাল থেকে তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে দেখছি এই সংস্থার কর্মীদের।” সংস্থার তরফে এ দিন ১৬ জন দুঃস্থ মেধাবী ছাত্রীর হাতে অর্থ সাহায্য তুলে দেওয়া হল।
অযোধ্যা গ্রামের রুণু কর্মকার এখন কলকাতার বাঙ্গুর রামকৃষ্ণ সারদা মিশন বিবেকানন্দ বিদ্যাভবনে বিএ পড়ছেন। তাঁর বাবা বাবলু কর্মকার বাড়ি ফেরা পথে বললেন, “ফ্রিডের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। কোনও দিন স্বপ্নেও ভাবিনি মেয়েকে এত দূর পড়াতে পারব।” ফ্রিডের সম্পাদক সোমনাথ পাইন বলেন, “শুধু স্কুল-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াটুকুই নয়, আমরা চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও ওদের প্রস্তুত করতে চাই।”
মল্লিকা, অপু, রুণু সাফল্যের স্বাদ পাওয়া বিজয়িনীদের তালিকা বেড়েই চলেছে। এ দিন তাদের দিকেই নিস্পলকে চেয়েছিলেন সোনামুখী কলেজের ছাত্রী শ্রীমতি হেমব্রম, সীমা রুইদাসরা। তাঁদেরও ইচ্ছা, “ওই দিদিদের মতো আমরাও অনেক পড়তে চাই। চাকরি করে বাড়ির সবাইকে সুখী করতে চাই।” |