ঠিক কী হয়েছিল মঙ্গলবার রাতে? কেন খুন হলেন পুরুলিয়ার হোটেল-ম্যানেজার ভাস্কর চট্টোপাধ্যায়? মঙ্গলবার রাতে কে বা কারা তাঁকে গুলি করল? পুলিশকে না জানিয়ে কেন নিজের হোটেলের ম্যানেজারকে বোকারোর হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন হোটেলের মালিক আশিস চট্টোপাধ্যায়? এখন তিনি কোথায়?
|
ভাস্কর চট্টোপাধ্যায়। |
বুধবার সকালে পুরুলিয়া শহরের নামোপাড়া এলাকায় ‘হোটেল পিনাকী সদন’-এ আগুন-ভাঙচুরের ঘটনার পরে এমনই নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে শহরের বাসিন্দাদের মনে। বেসরকারি ওই হোটেলটি মূলত বিয়ে, অন্নপ্রাশন বা অন্য কোনও অনুষ্ঠান ও সভার জন্য ভবনটি ভাড়ায় দেওয়া হয়। মাত্র বছরখানেক হল, ওই হোটেলে ম্যানেজারের পদে যোগ দিয়েছিলেন ৫৪ বছরের ভাস্করবাবু ওরফে বুটন। হোটেলের মালিক-ম্যানেজার, দু’জনেই শহরের নামোপাড়ার বাসিন্দা। পাড়ায় আগে ভাস্করবাবুর তেলেভাজার দোকান ছিল। সেটি এখন বন্ধ।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে এ-ও জানা যাচ্ছে, মঙ্গলবার গভীর রাতের পরে কেউ কেউ রক্তাক্ত ভাস্করবাবুকে হোটেল থেকে বের করে গাড়িতে তুলতে দেখেছেন আশিসবাবুকে। এই খবর জানাজানি হওয়ার পরেই এলাকায় চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ অভিযোগ করতে থাকেন, ভাস্করবাবুকে গুলি করার পিছনে রয়েছেন আশিসবাবুই। ভিড় বাড়তে থাকে ক্রমশই। হঠাৎই ক্ষিপ্ত জনতা চড়াও হয় তিন তলা ওই হোটেলে। ব্যাপক ভাঙচুর শুরু হয়। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় হোটেলটিতে। ভবনটির অনেকটা অংশই পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। |
হোটেল চত্বরে থাকা একটি গাড়ি ও একটি মোটরবাইক আশিসবাবুর ভেবে সেগুলিতেও আগুন ধরানো হয়। পরে অবশ্য জানা যায়, গাড়িটি একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের। পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে জনতাকে হটিয়ে দেয়।
বুধবার বেশি রাতে বোকারো থেকে ভাস্করবাবুর দেহ ফেরে পুরুলিয়ায়। নামোপাড়ায় তখন মানুষের ঢল নেমেছে। ফের গোলামালের আশঙ্কায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। বস্তুত, এ দিন সকাল থেকেই ভাস্করবাবুর বাড়িতে ছিল পড়শিদের ভিড়। বাড়িতে রয়েছেন ভাস্করবাবুর স্ত্রী বীণাদেবী ও দুই নাবালক ছেলে। এখ ছেলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। অন্য জন মাধ্যমিক পাশ করেছে। এ দিন বিকেল পর্যন্ত বীণাদেবীকে স্বামীর মৃত্যুসংবাদ দেওয়া হয়নি। বোকারোয় ভাস্করবাবুর দেহ আনতে গিয়েছিলেন তাঁর এক দাদা ভৈরব চট্টোপাধ্যায়। পুরুলিয়া ফিরে তাঁরা আশিসবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করবেন বলে তিনি ফোনে জানান। ভৈরববাবু বলেন, “আমাদের বাড়ির ছেলে গুলিবিদ্ধ হল। হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া হল। অথচ হোটেল থেকে মাত্র ১০০ ফুট দূরে ওর বাড়িতেই খবর দিলেন না আশিসবাবু! এটা আমাদের কাছে ভীষণ সন্দেহজনক ঠেকেছে।” |
এ দিন আশিসবাবুর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। ধাক্কা দিলেও কারও সাড়া মেলেনি। পুরুলিয়া পুরসভার প্রাক্তন কংগ্রেস কাউন্সিলর ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে হোটেলের মালিক আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় কাউকে তোয়াক্কা করেন না বা দুর্ব্যবহার করেন, এমন অভিযোগ এ দিন এলাকা ঘুরে বারবার শোনা গিয়েছে। এই ঘটনায় আশিসবাবুর নাম জড়ানোয় দৃশ্যতই অস্বস্তিতে কংগ্রেস-তৃণমূল, দু’দলই। জেলা কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রথীন্দ্রনাথ মাহাতো বলেন, “এক সময় উনি কংগ্রেসের টিকিটে পুরসভায় নিবার্চিত হলেও বর্তমানে তিনি তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী হিসেবেই পরিচিত।” পুরুলিয়ার বর্তমান পুরপ্রধান, তৃণমূলের তারকেশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “উনি দলের কর্মী, এটা ঠিক। তবে তাঁর এই আচরণ দল কখনওই সমর্থন করবে না!”
অন্য দিকে, নিহত ভাস্করবাবুর (বুটনদা হিসাবেই এলাকার পরিচিত) পরিচিত ছিল সমাজসেবী হিসেবে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, কেউ মারা গেলে শ্মশানে যাওয়ার জন্য, কাউকে রাত-বিরেতে হাসপাতালে নিয়ে যেতে তিনি সব সময় থাকতেন এক পায়ে খাড়া। কোনও গরিব বাড়ির মেয়ের বিয়ে দিতে সমস্যা হলেও যথাসাধ্য সাহায্য করতেন ভাস্করবাবু।
সেই মানুষটাকে কেউ কেন গুলি করে মারবে, এখনও বুঝতে পারছেন না এলাকার মানুষ। ফলে, তাঁর খুন হওয়ার খবর চাউর হতেই জনরোষ ছড়িয়ে পড়ে গোটা এলাকায়। নামোপাড়ার পাশের সরকারপাড়ার বাসিন্দা তথা জেলা যুব তৃণমূল সভাপতি গৌতম রায় বলেন, “বুটনদা এক জন আপাদমস্তক ভদ্রলোক ছিলেন। খুবই ভাল মানুষ। কেউ মারা গেলে শ্মশানে গিয়ে নিজে পারলৌকিক ক্রিয়া করতেন। তার জন্য কোনও পারশ্রমিক কখনও দাবি করেননি। কেউ খুশি হয়ে কিছু দিলে তবেই তা নিতেন।”
আশিসবাবু তাঁর ম্যানেজারকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে সেখান থেকে তাঁকে অন্যত্র স্থানান্তর করার সুপারিশ করা হয়। এর পরে আশিসবাবুকে তাঁকে নিয়ে যান বোকারোয়। আগেই পুলিশে খবর দেননি কেন সদর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, এই প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। সদর থানার দাবি, হাসপাতাল তাদের কিছু জানায়নি। যদিও হাসপাতালের সুপার নীলাঞ্জনা সেনের বক্তব্য, “পুলিশ ব্যাপারটা জানত।” |
পুরুলিয়ার হোটেলে খুন ম্যানেজার, তাণ্ডব |
গুলিতে এক হোটেল ম্যানেজারের খুন হওয়াকে ঘিরে বুধবার উত্তাল হল পুরুলিয়া শহর। ওই হোটেলে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল উত্তেজিত জনতা। পোড়ানো হল লজ চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাড়ি ও মোটরবাইকও। দমকলের তিনটি ইঞ্জিন এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। নিহত ভাস্কর চট্টোপাধ্যায় (৫৪) শহরের নামোপাড়া এলাকার বাসিন্দা। যে বেসরকারি হোটেলে তিনি ম্যানেজারের কাজ করতেন, সেটি ওই এলাকারই। বিয়ে বাড়ি, অন্নপ্রাশন বা অন্য কোনও অনুষ্ঠান ও সভা করার জন্য ভবনটি ভাড়ায় দেওয়া হয়। মঙ্গলবার গভীর রাতের ভাস্করবাবুকে খুন করা হয় বলে পুলিশের প্রাথমিক ভাবে অনুমান। এলাকাবাসীর অভিযোগের তির ওই হোটেলটির মালিক আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে হলেও বুধবার রাত পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ হয়নি। নামোপাড়ারই বাসিন্দা আশিসবাবু পুরুলিয়া পুরসভার প্রাক্তন কংগ্রেস কাউন্সিলর। বর্তমানে তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী। ফলে, এমন ঘটনায় দুই দলই অস্বস্তির মুখে পড়েছে। পুরুলিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দ্যুতিমান ভট্টাচার্য, ডিএসপি (শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণ) পিনাকী দত্ত পুলিশ বাহিনী নিয়ে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন। হোটেলের বাইরে পড়ে থাকা রক্তের দাগ পরীক্ষা করেন পুলিশ কর্তারা। জেলার পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীর কুমার বলেন, “ওই হোটেলে কোনও আবাসিক ছিলেন না। আমরা জানতে পেরেছি, গুলিবিদ্ধ ম্যানেজারকে হোটেলের মালিক নিজেই প্রথমে পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে নিয়ে যান বোকারোর একটি হাসপাতালে। ঠিক কী ঘটেছিল, কেনই বা গুলি চলল, তা তদন্তসাপেক্ষ। হোটেল মালিকের খোঁজ চলছে।” পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, মঙ্গলবার গভীর রাতের পরে কেউ কেউ রক্তাক্ত ভাস্করবাবুকে হোটেল থেকে বের করে গাড়িতে তুলতে দেখেছেন আশিসবাবুকে। এই খবর চাউর হতেই এ দিন সকালে ক্ষিপ্ত জনতা হোটেলটিতে চড়াও হয়। ভাস্করবাবুর বাড়িতে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী ও দুই নাবালক ছেলে। নিহতের এক দাদা ভৈরব চট্টোপাধ্যায় এ দিন বোকারো গিয়েছিলেন ভাইয়ের দেহ আনতে। সেখানেই দেহের ময়নাতদন্ত হয়। ফোনে ভৈরববাবু বলেন, “পুরুলিয়ায় ফিরে হোটেল মালিক এবং আরও কয়েক জনের নামে আমরা অভিযোগ দায়ের করব।” |