হিমঘর উপচে পড়ছে। বাজার খাঁ খাঁ!
আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে রাজ্য সরকার কোমর বেঁধে নামার চার দিন পরে ছবি এমনটাই। যে বাজারে যৎসামান্য আলু রয়েছে, সরকারি নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তার দাম আকাশছোঁয়া। কোথাও ২০ টাকা কেজি তো কোথাও ৩৫ টাকা। ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয় পক্ষেরই অভিযোগ, সরকার আলুর দাম বেঁধে দেওয়ার পর থেকেই পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর
হয়ে উঠছে।
সরকার অবশ্য এখনও নিজের অবস্থানে অনড়। শাসক দলের নেতাদেরও অনেকের বক্তব্য, এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর অন্যায় লোভের কারণেই সমস্যা তৈরি হয়েছে। অতএব তা কড়া হাতে মোকাবিলা করাই দরকার। আলু-পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে বুধবার পথে নেমেছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বস্তুত, দাম নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব যাদের, সেই কৃষি বিপণন দফতরের ভার আপাতত নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন তিনি। মমতা বলেন, “আমি অরূপকে (কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায়) বলেছি, তোমার হাতেই দফতর থাকছে। কিন্তু আগামী কিছু দিনের জন্য আমি কাজ দেখভাল করব।” |
আলু বেরোচ্ছে কামারকুণ্ডুর একটি হিমঘর থেকে। বুধবার নিজস্ব চিত্র। |
এ দিন কোলে মার্কেট এবং কলেজ স্ট্রিট বাজার পরিদর্শনের পরে নবান্নে ফিরে আলু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর অভিযোগ, প্রচুর আলু থাকা সত্ত্বেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত লাভের আশায় রাজ্যের বাইরে আলু পাঠাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “যাঁরা এই কাজ করছেন, তাঁদের আমি জানি। তাঁদের কেউ ঘাটশিলায়, কেউ জালন্ধরে চলে গিয়েছেন। আমি নির্দেশ দিয়েছি, তাঁদের ধরে আনার জন্য।”
ওই সব আড়তদারদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি সব জেলার জেলাশাসক, পুলিশ সুপার, এসডিও, বিডিও সকলকেই নির্দেশ দিয়েছি, একটি লরিও যেন রাজ্যের সীমানা অতিক্রম করতে না পারে। সবাইকে ২৪ ঘণ্টা নজর রাখার কথা বলেছি। জেলার পাশাপাশি কলকাতাতেও নজর রাখবে পুলিশ, সিআইডি এবং এনফোর্সমেন্ট শাখা।”
কিন্তু এত কড়াকড়িতেও আলু যে সুলভ হয়নি, বাজারে গিয়ে সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝছেন আমজনতা। বাজারে বাজারে আলু পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল সরকার। মঙ্গলবার পুরসভা এবং কৃষি বিপণন দফতর মিলিয়ে কলকাতার বাজারে পৌঁছে দিয়েছিল ৬৫ মেট্রিক টন আলু। বুধবার তা বেড়ে ৮২ মেট্রিক টন হলেও সেটা শহরের মোট চাহিদার মাত্র ৪ শতাংশ।
কৃষি বিপণন দফতর সূত্রে মঙ্গলবার বলা হয়েছিল, শ্রমিকের অভাবের কারণেই হিমঘর থেকে আলু বার করা যাচ্ছে না। ফলে বাজারে সরবরাহ মার খাচ্ছে। এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় বুধবার থেকে একশো দিনের কাজের শ্রমিকদের এই কাজে লাগানোর পরিকল্পনা হচ্ছে। কিন্তু এ দিনও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
ফলে বাজারে গিয়ে আলু না-পেয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। অনেকেই বলছেন, সরকার আসরে নামার আগে ১৫ টাকা কেজি দরে আলু মিলছিল। কিন্তু দাম ১৩ টাকায় বেঁধে দেওয়ার পরে বাজারে পড়ে থাকা সামান্য আলু দেড় থেকে তিন গুণ দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। অনেকেই এই পরিস্থিতির সঙ্গে বাস ভাড়া না-বাড়ানোর ব্যাপারে সরকারি জেদের মিল পাচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য, বাস ভাড়া কিছুটা বাড়ানো হলে রাস্তায় বাস থাকত। কিন্তু এখন বাস অমিল হয়ে গিয়ে অটোতে যাতায়াত করতে হচ্ছে অনেক বেশি খরচ করে। আলু ব্যবসায়ীদের একাংশের বক্তব্য, সরকার যে দর বেঁধে দিয়েছে, তার থেকে দু’টাকা বেশি ধার্য করলেই তাঁদের পুষিয়ে যেত।
রাজ্য অবশ্য এই যুক্তি মানছে না। তাদের দাবি, দাম বেঁধে দেওয়ার সময় চাষি এবং ব্যবসায়ীদের লাভের কথাও ভাবা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন অভিযোগ করেন, গত বৃহস্পতিবার তাঁর সঙ্গে আলোচনায় আলু ব্যবসায়ীরা ১১ টাকা পাইকারি দরে এবং খুচরো বাজারে ১৩ টাকায় আলু বিক্রি করার আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিন্তু “কথার খেলাপ করে রাজ্যের মানুষের সঙ্গে তাঁরা বিশ্বাসঘাতকতা এবং প্রতারণা করছেন। কিছু আড়তদার কৃত্রিম ভাবে এই সঙ্কট তৈরি করছেন। বেআইনি ভাবে চাষিদের কাছ থেকে আলু কিনে মজুত করে রাখছেন।”
যা শুনে এক আলু ব্যবসায়ীর মন্তব্য, “এই দামে আলু বিক্রি করলে লাভের মুখ দেখা কার্যত অসম্ভব। ঘর থেকে পয়সা এনে কে ব্যবসা করতে যাবে? সরকার-ই বরং ভর্তুকি দিয়ে আলু বিক্রি করুক।”
বাস্তবে অবশ্য তা-ই হতে চলেছে। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, আড়তদাররা যদি নিজেরা হিমঘর থেকে আলু বার করে বিক্রি করেন ভাল, না হলে প্রশাসনই হিমঘর থেকে আলু বার করে বিক্রির ব্যবস্থা করবে। বুধবার রাত থেকেই স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় হিমঘরগুলি থেকে আলু বের করে বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হবে। আলু রাখার জন্য সখেরবাজারে ইতিমধ্যেই গুদাম তৈরি হয়েছে। স্ট্র্যান্ড রোডেও একটি গুদাম করা হবে।
আলু ব্যবসায়ী, আড়তদারদের
প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, “আগুন নিয়ে খেলা করবেন না। মানুষকে বঞ্চিত করে বাইরের রাজ্যে আলু চালান করলে রাজ্যের সাধারণ মানুষ আপনাদের ক্ষমা করবেন না।” সাধারণ মানুষকেও এ ব্যাপারে সচেতন থেকে বেশি দামে আলু না-কেনার পরামর্শ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী জানান, আজ, বৃহস্পতিবার থেকে কলকাতার ৩৬টি পুর বাজার ছাড়াও মাদার ডেয়ারির বুথে সরকার নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি হবে। একই সঙ্গে সরকার নির্দিষ্ট দরে আলু বিক্রি করবে রাজ্যের কৃষি এবং উদ্যানপালন দফতর।
আলু ভিন্ রাজ্যে পাঠানোর উপরে সরকারি নিষেধাজ্ঞা নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে আলু ব্যবসায়ীদের মধ্যে। তাঁদের বক্তব্য, এখানে সরকারে বেঁধে দেওয়া দামে আলু বিক্রি করে লাভের মুখ দেখা যাবে না। অন্য রাজ্যে আলু বিক্রি করে লাভ তোলারও কোনও উপায় থাকছে না। সেই কারণেই হিমঘর থেকে আলু বার করতে উৎসাহী হচ্ছেন না তাঁরা।
কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া এ দিন জানান, পশ্চিম মেদিনীপুরের থেকে আলু নিয়ে ওড়িশা যাওয়ার সময় ২২৫টি লরি সরকারি বিধি নিষেধে মগরামপুর, বেলদা সড়কে আটকে রয়েছে। এই লরিগুলিকে ছেড়ে দেওয়ার জন্যেও তিনি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য ভিন্ রাজ্যে আলু পাঠানোর সম্ভাবনা এ দিনও খারিজ করে দিয়েছেন। অসম ও ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে আলু পাঠানোর জন্য ফোন করেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “ওঁরা আমার ভাল বন্ধু। কিন্তু আমি ওঁদের বলে দিয়েছি, রাজ্যবাসীকে বঞ্চিত করে আমি আলু রফতানি
করব না।” |