জোগান দেওয়ার ভার নিয়েছে খোদ রাজ্য সরকার। হিমঘরেও অভাব নেই আলুর। সেখানে মজুত আছে অন্তত ১৬ লক্ষ মেট্রিক টন। তা সত্ত্বেও কলকাতা এবং শহরতলির দৈনিক চাহিদার তিন শতাংশ আলুও সরবরাহ করতে পারল না কৃষি বিপণন দফতর! মঙ্গলবার, ভাইফোঁটার দিন মহানগরের বেশির ভাগ বাজারে তাই হন্যে হয়ে খুঁজেও আলু পেলেন না ক্রেতারা।
রাজ্য সরকারের তথ্য অনুযায়ী শহর ও শহরতলি মিলিয়ে কলকাতায় দৈনিক আলুর চাহিদা ২৪০০ মেট্রিক টন। কিন্তু সরকারি ব্যবস্থায় এ দিন শহরে মাত্র ৬৫ মেট্রিক টন আলু দেওয়া গিয়েছে। ফলে কোনও কোনও বাজারে আলুর দোকান বন্ধ। কোথাও কোথাও বেঁধে দেওয়া দামের তোয়াক্কা না-করে চড়া দামে বিকিয়েছে আলু। ক্রেতাদের একাংশের অভিযোগ, অনেক বাজারে টাকা দিয়েও আলু মেলেনি। আলুহীন এমন ভাইফোঁটা আগে হয়েছে কি না, মনে করতে পারছেন না শহরের প্রবীণেরাও।
রাজ্যে কি আলুর সঙ্কট রয়েছে?
সরকারি তথ্যই বলছে, হিমঘরে প্রায় ১৬ লক্ষ মেট্রিক টন আলু আছে। সেখানে আলু রাখার মেয়াদ শেষ হবে ৩০ নভেম্বর এবং তার মধ্যেই সব আলু বের করে নিতে হবে। হিমঘর থেকে বের করার পরে আর এক মাস রাখা যায় আলু। অর্থাৎ মজুত আলু শেষ করতে হবে ডিসেম্বরের মধ্যেই। চলতি মাসেই রাঁচি ও পঞ্জাবের আলু চলে আসবে। ডিসেম্বরে বাজারে এসে যাবে এ রাজ্যের নতুন আলুও।
কৃষি বিপণন দফতরের এক কর্তা বলেন, রাজ্যে আগামী দু’মাসে খাওয়ার জন্য খুব বেশি হলে ন’লক্ষ মেট্রিক টন আলু লাগবে। বীজের জন্য রাখা হবে চার লক্ষ মেট্রিক টন। অর্থাৎ ডিসেম্বরের মধ্যে সব মিলিয়ে রাজ্যে ১৩ লক্ষ মেট্রিক টনের বেশি আলুর প্রয়োজন হবে না। হিসেব বলছে, এখন হিমঘরে যে-আলু আছে, তাতে চাহিদা মিটিয়েও তিন লক্ষ মেট্রিক টন উদ্বৃত্ত হবে। অর্থাৎ প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশি আলু মজুত আছে। অথচ মানুষ বাজারে গিয়ে আলু না-পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
কিন্তু এই অবস্থা তৈরি হল কেন?
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী খুচরো বিক্রেতাদের কাছে ১১ টাকা কিলোগ্রাম দরে জ্যোতি আলু সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ঠিক হয়, শখেরবাজারে সরকারি গুদাম থেকে লরিতে আলু পৌঁছে দেওয়া হবে বিভিন্ন বাজারে খুচরো বিক্রেতাদের কাছে। লরির ভাড়া মেটাবে সরকারই। মঙ্গলবার সকালে সেই কাজ শুরু হলেও বাজারে আলু পৌঁছতে প্রায় সাড়ে ৯টা বেজে যায়। দোকানদারদের চাহিদামতো আলু সরবরাহও করতে পারেনি কৃষি বিপণন দফতর।
এক সরকারি কর্তা বলেন, “আলুর ব্যবসা চলে তার নিজস্ব ছন্দে।
হিমঘর থেকে খুচরো বাজারে আলু পৌঁছনোর প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকেন বহু ব্যবসায়ী। তাঁদের ছেঁটে ফেলে সরকারি কর্মীরা এর মধ্যে ঢুকে পড়ায় এই বিপত্তি ঘটেছে।”
আলু পৌঁছে দিতে গিয়ে সরকারি কর্তাদের এ ভাবে নাকানিচোবানি খেতে হল কেন?
এক পদস্থ পুর অফিসারের ব্যাখ্যা, “জোগানের অভাবেই শহরের অনেক বাজারে এ দিন চাহিদামতো আলু দেওয়া যায়নি। প্রথম দিন বলেই একটু গোলমাল হয়েছে।” তাঁর দাবি, একটু বেলা হলেও যাদবপুর, বেহালার কিছু বাজারে আলু পৌঁছে দেওয়া গিয়েছে। তার আগেই অবশ্য ওই সব বাজারে আলু না-পেয়ে ফিরে যান ক্রেতারা। উত্তর, মধ্য কলকাতা ও গার্ডেনরিচের অনেক বাজারে আলুর লরি নিয়ে যেতেই পারেনি সরকারি কর্তারা।
বিপত্তির অন্য একটি ব্যাখ্যা দেন মেয়র-পারিষদ (বাজার) তারক সিংহ। তিনি বলেন, “আলুর চাহিদা কত, প্রতিটি বাজারকেই তা জানাতে বলা হয়েছিল। কিন্তু অনেক বাজার সময় মতো তা জানায়নি। তাই আলুর লরি বিভিন্ন বাজারে পৌঁছতেই অনেক খুচরো বিক্রেতা তা নেওয়ার জন্য ভিড় করেন। কিন্তু জোগান কম থাকায় সকলকে সন্তুষ্ট করা যায়নি।”
রাজ্যের তরফে বলা হচ্ছে, বাজারে ঠিকমতো আলু পৌঁছে দিতে যত শ্রমিক দরকার, সংখ্যাটা তার থেকে কম বলেই সমস্যা দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে আজ, বুধবার থেকে ১০০ দিনের কাজের শ্রমিকদের ব্যবহার করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আশা, তাতে পরিস্থিতি অনেকটাই সামাল দেওয়া যাবে।
কৃষি বিপণন দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর গৌতম মুখোপাধ্যায় জানান, এ দিন সর্বসাকুল্যে ৬০০ প্যাকেট (৩০ মেট্রিক টন) আলু দেওয়া গিয়েছে পুরসভাকে। শহরের আটটি কেন্দ্র থেকে প্রায় ৭০০ প্যাকেট (৩৫ মেট্রিক টন) আলু বিক্রি করেছে সরকার নিজেই। সব মিলিয়ে মাত্র ৬৫ মেট্রিক টন আলু বিলি করা হয়েছে।
একই অবস্থা বিভিন্ন জেলাতেও। মেদিনীপুর শহরে মাত্র দু’টি জায়গায় সরকারি আলু বিক্রি হয়েছে। সরকারি ভাবে যৎসামান্য আলু বিক্রির ব্যবস্থা হয়েছে উত্তর দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারে। দার্জিলিং, মালদহ ও দক্ষিণ দিনাজপুরে সরকারি দরে আলু বিক্রির ব্যবস্থা না-হওয়ায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বাসিন্দাদের অভিযোগ পৌঁছেছে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের কাছেও। তিনি বলেন, “এই ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে হবে সকলকেই। জেলাশাসকদের সঙ্গে কথা বলছি।”
রাতারাতি আলু উধাও হয়ে গিয়েছে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর বাজার থেকেও। ফরাক্কা, ধুলিয়ানে কিছু কিছু আলু বিকিয়েছে ১৭-২০ টাকা দরে। ফরাক্কা থেকে সাগরদিঘি কোথাও প্রশাসনিক উদ্যোগ চোখে পড়েনি। জ্যোতি আলুর অভাবে বাসিন্দাদের দুর্ভোগ বেড়েছে। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূমেও বাজার থেকে আলু উধাও। সামান্য কিছু বিকোচ্ছে বেশি দামে।
|