শুরু হয়েছে জগদ্ধাত্রী পুজোর ‘কাউন্ট ডাউন’। এরই মাঝে কালীপুজোয় যেন নেট প্র্যাকটিস সেরে নিলেন কৃষ্ণনাগরিকরা। জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্য এই শহর বিখ্যাত। জগদ্ধাত্রীই এই শহরের বড় উৎসব। কৃষ্ণনাগরিকরা তাই সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন উৎসবের এই দিনগুলির জন্য। এই শহরে তাই ম্লান হয়ে যায় বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব, দুর্গাপুজোও। শারদ উৎসবে যখন সমস্ত বাঙালি উৎসবে মেতে ওঠেন, এই শহর তখন ঝিমিয়ে থাকে। যেন নীরবে সেরে নেয় তার বড় উৎসব জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রস্তুতি। তবে কেবলমাত্র জগদ্ধাত্রীকে আঁকড়ে ধরে থাকা এই শহরের বুকে কিন্তু ধীরে ধীরে একটা পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। ক্রমশ যেন জৌলুস বাড়তে শুরু করেছে কালীপুজোর। শুধু কালীপুজো বা তার পরের দিন নয়, বিসর্জনের দিনও রাজবাড়ি থেকে কদনতলা ঘাট পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে ছিল উপচে পড়া মানুষের ভিড়। বোঝা যাচ্ছে, নতুন প্রজন্ম আর শুধু জগদ্ধাত্রীকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চান না। তাঁরা বিকল্প কোনও উৎসবের সন্ধান করতে শুরু করেছেন।
কয়েক বছর ধরে কালীপুজো করে আসছেন শহরের নবজাগরণ ক্লাবের সদস্যরা। প্রথম দিকে তেমন জৌলুস না থাকলেও ক্রমশ সেটা বাড়ছে। এ বার যেমন তাদের বাজেট ছিল প্রায় দু’লক্ষ টাকা। ক্লাবের কর্মকর্তাদের দাবি, আসলে শহরের মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। আমরা বুঝতে পারছি, তাঁরাও চাইছেন জগদ্ধাত্রী পুজো ছাড়াও অন্য কোনও উৎসব হোক যেখানে তারা আনন্দে মেতে উঠতে পারবেন। এর কারণ কী?
|
জবাবে ক্লাবের সম্পাদক শম্ভু দাস বলেন, “আসলে জগদ্ধাত্রী পুজো হয় মাত্র দু’দিনের জন্য। এর জন্য সারা বছর অন্য উৎসবের দিকে তাকিয়ে বসে থাকাটা আর মেনে নিতে পারছেন না শহরের সাধারণ মানুষ। বলা যায় অল্প দিনের আনন্দ যেন পোষাচ্ছে না। তাঁরা আনন্দ করার জন্য আরও একটু সময় পেতে চান।” তিনি আরও বলেন, “কয়েক বছর ধরেই আমরা লক্ষ করছিলাম কালীপুজোতেও মানুষ রাস্তায় নামছেন। মণ্ডপে ভিড় বাড়ছে। বুঝতে পারলাম মানুষের চাহিদা।”
কিন্তু মানুষ যদি আরও বেশি উৎসবে মেতে ওঠার সুযোগ চান তা হলে দুর্গাপুজো হয় না কেন? কালীপুজোর উদ্যোক্তারা বলেন, “দুর্গাপুজোর অনেক খরচ। আবার জগদ্ধাত্রী পুজোটাও ধুমধামের সঙ্গেই করতে হবে। মানুষের পক্ষে কয়েক দিনের ব্যবধানে দু’বার মোটা টাকা চাঁদা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই অপেক্ষাকৃত কম খরচের একদিনের কালীপুজোকেই বেছে নেওয়া হয়েছে।” কৃষ্ণনগর ও আশপাশের এলাকায় এ বছর ৯৫টি কালীপুজোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর বাইরেও ছোটবড় মিলিয়ে আরও প্রায় ৫০টি পুজো অনুমতি ছাড়াই হচ্ছে। এর মধ্যে শহরের বুকেই নবজাগরণ, চ্যালেঞ্জ, অনামিকা, সেবক সংঘ, রক্তজবা, নিউ রক্তজবা, অগ্রদূত, রেলওয়ে যুবক সঙ্ঘ, রান, ঘুর্ণি আগমেশ্বরী ও স্বাতী ক্লাব-সহ একাধিক ক্লাবের কালীপুজো আস্তে আস্তে নজর কাড়তে শুরু করেছে। তবে কালীপুজো জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পিছনে গভীর সামাজিক কারণও আছে। দুর্গাপুজোর সময় সরকারি ভাবে ছুটি থাকে। কিন্তু সেই সময় শহরে তেমন কোনও উৎসবের পরিবেশই থাকে না। আবার জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় ছুটি পাওয়া যায় না। বিশেষ করে যাঁরা কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন তাঁদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা আরও প্রকট। অথচ কালীপুজো আর ভাইফোঁটা উপলক্ষে ছুটি পাওয়া যায়। বেশ কয়েক বছর আগে স্কুলের বন্ধুরা মিলে পুরসভার পাশে সরস্বতী পুজো শুরু করেছিল। কয়েক বছর ধরে সেই পুজো ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু ক্লাবের সদস্যরা একে একে কর্মসূত্রে বাইরে চলে যেতে থাকলে সমস্যা দেখা দেয়। তখন ঠিক হয় সরস্বতী পুজো নয়, এবার থেকে কালীপুজো করা হবে। ক্লাবের অন্যতম কর্মকর্তা অনিন্দ্য রায় বলেন, “শুধু আমাদের ক্লাবের ক্ষেত্রেই নয়। অন্যান্য জায়গাতেও প্রায় একই অবস্থা। যাঁরা বাইরে থাকেন তাঁরা তো জগদ্ধাত্রী পুজোয় ছুটি পান না। ফলে আসতেও পারেন না। এমন মানুষের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। তাই কালীপুজোর জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে।” নতুন প্রজন্মের সার কথা, শ্রেষ্ঠত্বের আসনে জগদ্ধাত্রীই থাকুন, কিন্তু তার পাশাপাশি শহরের বুকে কৌলীন্য পেতে চান কালীও। |