উইকেট পিছু বিরিয়ানি থেকে স্বপ্নের অভিষেক
হম্মদ সামির বিষাক্ত ডেলিভারিগুলো ঠিক যে সময় ক্যারিবিয়ান ব্যাটিংকে ছিন্নভিন্ন করে ছাড়ছে, তখন তাঁর বঙ্গজ তিন বন্ধুর এক জনও ইডেনে ছিলেন না।
কলকাতা নয়, ওঁরা তিন ছিলেন ‘কভার্স’-এ। আদতে যা রাজস্থান ক্রিকেট অ্যাকাডেমির লাঞ্চরুম। যেখানে রঞ্জি ট্রফির প্র্যাকটিস তাড়াহুড়োয় শেষ করে লাঞ্চরুমে ঢুকে পড়েছিলেন টিমের সঙ্গে, প্লেটের চেয়ে মনোযোগ বেশি দেওয়ালের এলসিডি টিভিতে, এবং মহম্মদ সামির তিন বন্ধুর মঙ্গলবার দুপুরের কথোপকথনের যে সন্ধান জয়পুরে ফোন করে পাওয়া গেল তা মোটামুটি এ রকম:
অশোক দিন্দা: রিভার্স সুইংটা দ্যাখ। কত জোরে হিট করাচ্ছে। বল তো কেউ ঠেকাতেই পারছে না!
সৌরাশিস লাহিড়ী: পারবে কী করে? অফ বা অফ-মিডলে ফেললে ওকে কেউ আজ পর্যন্ত আটকাতে পেরেছে?
ঋদ্ধিমান সাহা: যা করছে, তাতে তো দেখছি দক্ষিণ আফ্রিকা যাওয়ার চান্স আছে।
(নেপথ্যে তখন বাংলা কোচ অশোক মলহোত্র-র গলা, “সামিকে দেখে তোমরা যদি ভাল খেলো, তা হলে তার মানে হচ্ছে আরও কয়েক জন সামির ভারতীয় দলে খেলা।”)
আর ক’জন ‘মহম্মদ সামি’ পরবর্তীকালে টেস্ট ক্যাপ পাবেন, বা আদৌ পাবেন কি না, উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ। এর পর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে বাংলা পেসারকে দেখা যাবে কি না, সেটাও সময় বলবে। কিন্তু বুধবারের ইডেনে বাংলা পেসার একটা ব্যাপার বুঝিয়ে গেলেন।
মহম্মদ সামি ১৭-২-৭১-৪

শিকার মার্লন স্যামুয়েলস। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
অভিষেকটা একে ঘরের মাঠে হল, তার উপর সঙ্গে আবার সচিন। অবিশ্বাস্য লাগছে।
টেস্টে ভারতের হয়ে কিছু করার স্বপ্ন দেখতাম। সবচেয়ে আনন্দ দিচ্ছে প্রথম উইকেটটা।
এই কৃতিত্ব পরিবার এবং সচিনকে উৎসর্গ করলাম।
উইকেট পিছু এক প্লেট বিরিয়ানির চুক্তিতে ক্রিকেটজীবন শুরু করেও এক দিন সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের সঙ্গে ইডেনের ঐতিহাসিক টেস্টে নামা যায়। আজও সব বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি এমন এক প্রত্যন্ত গ্রামে (উত্তরপ্রদেশের সহসপুর) জন্মেও এক দিন ঢুকে পড়া যায় ভারতীয় ক্রিকেটের ‘তাজমহলে।’ নিজের অভিষেক টেস্টে নেমেই মনে করিয়ে দেওয়া যায় সাতচল্লিশ বছর আগের ভারতীয় পেসারের এক বিখ্যাত রেকর্ড। বাঙালিকে কিছুক্ষণের জন্য ফিরিয়ে নেওয়া যায় ’৯৬-এর লর্ডসের এক সকালে।
শুধু যদি চেষ্টাটা সৎ থাকে।
’৬৬-৬৭-র আবিদ আলির অ্যাডিলেডে ছ’উইকেটের পর কোনও পেসারের এত দুর্দান্ত অভিষেক পরের চার দশকে আর দেখেনি ভারতীয় ক্রিকেট। বুধবারের ইডেন যা দেখল। আর ’৯৬-এর লর্ডসে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের রাজকীয় অভ্যূত্থানের পরে বাংলার কোনও ছেলেকেও তো এ রকম টেস্ট অভিষেক ঘটাতে দেখেনি বাঙালি। সামির ১৭-২-৭১-৪ হিসেব মনে পড়িয়ে দিল একে একে সব, শীতের ইডেনে বিস্ময়ে বাক্-শক্তিরহিত করে ছাড়ল ক্রিকেট-ব্যক্তিত্বদের।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় মুগ্ধ। কর্পোরেট বক্সে বসা কারসন ঘাউড়ি কোথাও গিয়ে খুঁজে পাচ্ছেন ইডেনে নিজের অভিষেকের দিন। ক্লাবহাউস লোয়ার টিয়ারে বসে ম্যাচ দেখে প্রাক্তন জাতীয় নির্বাচক প্রণব রায়ের মনে হল, এত সহজ অ্যাকশন-রান আপ-ফলো থ্রু সামিকে বহু দিন ভারতীয় ক্রিকেটে ‘বাঁচিয়ে’ রাখবে। চোট লাগবে কম, সামি ছুটবেন বেশি। মোহনবাগান সহ-সচিব সৃঞ্জয় বসু তো ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, এক লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে তাঁর ক্লাবের ক্রিকেটার সামিকে।
কমেন্ট্রি বক্স থেকে বেরিয়ে সৌরভ যেটা বলে গেলেন, সেটা দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের দল নির্বাচনে সসম্মানে পাশ হয়ে যাওয়া উচিত। “এর পর সামি সাউথ আফ্রিকায় অটোমেটিক চয়েস। বল যে ভাবে রিভার্স করিয়েছে, এক কথায় অসাধারণ,” বলছিলেন সৌরভ। ঘটনা হল, সামির রিভার্স করানোর দক্ষতার সঙ্গে আরও একটা ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতাও উঠে আসছে। বলা হচ্ছে, হাওয়ায় সুইং করানো নয়, সামি পছন্দ করেন সিমে হিট করিয়ে ব্যাটসম্যানকে মুভমেন্টে বিভ্রান্ত করতে। যে কারণে ব্যাটসম্যান বলের গতিবিধি বোঝার সময় পায় আরও কম, বেশির ভাগ সময় বোল্ড হয়ে যায়। উদাহরণমার্লন স্যামুয়েলসের মিডল স্টাম্প ছিটকে পড়া। উদাহরণ দীনেশ রামদিনের লেগস্টাম্পের গড়াগড়ি। যা এ দিন ইডেনে উপস্থিত কয়েক জন প্রাক্তন ক্রিকেটারের কথায়, “বেশ চমকপ্রদ।”
টেস্ট অভিষেকের প্রথম ইনিংসে ভারতীয় পেসাররা
• আবিদ আলি (বনাম অস্ট্রেলিয়া, অ্যাডিলেড, ১৯৬৭)
১৭ ওভার ২ মেডেন ৫৫ রান ৬ উইকেট
• মহম্মদ নিসার (বনাম ইংল্যান্ড, লর্ডস, ১৯৩২)
২৬ ওভার ৩ মেডেন ৯৩ রান ৫ উইকেট
• মন্টু বন্দ্যোপাধ্যায় (বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইডেন, ১৯৪৮-৪৯)
৩০ ওভার ৩ মেডেন ১২০ রান ৪ উইকেট
• জাভাগল শ্রীনাথ (বনাম অস্ট্রেলিয়া, ব্রিসবেন, ১৯৯১)
২৪.৪ ওভার ৪ মেডেন ৫৯ রান ৩ উইকেট
• জাহির খান (বনাম বাংলাদেশ, ঢাকা, ২০০০)
২১ ওভার ৬ মেডেন ৪৯ রান ২ উইকেট
• কপিল দেব (বনাম পাকিস্তান, ফয়জলাবাদ, ১৯৭৮)
১৬ ওভার ২ মেডেন ৭১ রান ০ উইকেট

“আবিদ আলির পর কোনও ভারতীয় পেসারের এ রকম অভিষেক হয়নি। খুব ভাল বল রিভার্স করিয়েছে সামি। ওর আত্মবিশ্বাস এ বার অনেক বেড়ে যাবে।”

“কঠোর পরিশ্রম করেছে। সেটারই ফল দেখা গেল আজ।”

“এই পিচে উইকেট টু উইকেট রাখার দরকার ছিল। সামি সেটাই করেছে।”
যা ঠিক বাংলা পেসারের জীবনের মতো। সাত বছর আগে কলকাতায় ম্যাচ-পিছু হাজার টাকায় খেলতে হয়েছে সামিকে। টাউন ক্লাবে তাঁর ময়দানি ‘গুরু’ দেবব্রত দাস এক সময় সামিকে তাতাতেন, “উইকেট পেলে বিরিয়ানি পাবি,” বলে। কারণ, ক্রিকেটের মতো ওই খাদ্যবস্তুর উপরও বঙ্গ পেসারের বিশেষ ভক্তিশ্রদ্ধা আছে। আর মানুষ কেমন? সারল্যের উদাহরণ শুনলে সত্যিই আশ্চর্য লাগবে। শোনা গেল, তাঁর নতুন কেনা সাউথ সিটির ফ্ল্যাটের দলিল নাকি রেখে দিয়েছেন ওই ময়দানি ‘গুরু’-র কাছে। টাকাপয়সার কথা আজও নাকি সরাসরি বলতে পারেন না। এখনও প্র্যাকটিস না থাকলে তাঁর দিন কাটে ঘুমিয়ে, নইলে মোবাইলে গেম খেলে। কী করা যাবে, যৌবনধর্ম মেনে কোনও কিছুই নাকি বিশেষ পছন্দের নয়। এমনকী সিনেমা হলে ঢোকাটাও নয়!
বোধহয় সেই সারল্যই চার উইকেট নিয়ে স্বপ্নের টেস্ট অভিষেকের পরেও বাংলা পেসারকে দিয়ে বলিয়ে দেয়, “আমার নামটা একটু দেখে নেবেন প্লিজ। সামি আহমেদ নয়, আমি মহম্মদ সামি।” বোধহয় তাই ওয়ান ডে থেকে টেস্ট বলের অ্যাডজাস্টমেন্টের কচকচিতে না ঢুকে খুব সহজ উত্তর দিতে পারেন, “আমার কাছে তো শুধুই রঙের তফাত।” প্রথম টেস্টের কৃতিত্ব অনায়াসে যিনি ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিতে পারেন পরিবার এবং সচিনের সঙ্গে, গর্বের দিনেও শিকড় না ভুলে বলে যেতে পারেন, “যেখান থেকে এসেছিলাম, সেখানে ক্রিকেটের তো কোনও জায়গাই ছিল না!”
সহসপুরে ছিল না। কলকাতায় আছে। কিন্তু তার পরেও নাকি মহম্মদ সামির জীবনে অনেক কিছু পাল্টায়নি। যেমন, জুতো নিয়ে তাঁর খুঁতখুঁতানি। মরসুমের শুরুতে যে জুতো পরে বল করলে উইকেট আসে, সেটাকে নাকি সহজে ছাড়তে চান না। ছিঁড়ুক, ফাটুক তাতে নাকি তাঁর কিছুই আসে যায় না।
বুধবার ইডেনে যে হাজার চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ দর্শক সামির বোলিং দেখে গেলেন, তাঁদের কেউ তাঁর জুতোর দিকে খেয়াল করেছিলেন কি?
শোনা গেল, দু’দিন আগে ইন্ডিয়ান ড্রেসিংরুমে মুচি ডেকে এই জুতোটাও সামির সেলাই করা!




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.