লুকিয়ে ইডেনে এসেও স্বামীর কাছে ধরা পড়ে গেলেন অঞ্জলি
“আচ্ছা, ক্যাপ্টেন তো সচিনকে বল দিলে পারে? টি-র আগে একটা ওভারও কি ও করতে পারে না?”
ক্লাব হাউসের লোয়ার টিয়ারে বসে বলছিলেন সুন্দরী মহিলা। ধবধবে ফর্সা। চোখে সানগ্লাস। পরনে লেপার্ড প্রিন্ট শার্ট। খয়েরি ট্রাউজার্স। গোটা ইডেনেরই সমবেত দাবি তখন তা-ই। ধোনি কি এক বার সচিনের লেগস্পিনে ভরসা করতে পারেন না? সুন্দরীর নামধাম, কুলগোত্রে তাই কিছু এসে যায় না।
আসলে এসে যায় কারণ, তাঁর নাম অঞ্জলি তেন্ডুলকর! ভারতের সর্বকালের সবচেয়ে আলোচিত ক্রিকেটার-পত্নী।
দ্রুতই যেন অদৃশ্য ওয়াকিটকিতে ভারত অধিনায়ক শুনে ফেললেন সেই প্রার্থনা। বল তুলে দিলেন সচিনকে। আর চতুর্থ বলেই কি না উইকেট! প্রায় তিন বছর খরা চলার পরে টেস্ট উইকেট। ক্লাব হাউস জনতা ততক্ষণে ঘিরে ধরেছে অঞ্জলিকে; আপনি লাকি, প্রচণ্ড লাকি। প্লিজ, এখানেই বসে থাকুন। মুম্বই আর লন্ডন থেকে তাঁর সঙ্গে আগত সচিনের বন্ধুরা লাফাচ্ছেন। ছেলে অর্জুন শিহরিত। অঞ্জলিকে দেখে মনে হল কোনওক্রমে নিজেকে সংযত রেখেছেন। কিন্তু একেবারে উদ্বেলিত।

উচ্ছ্বাস। ১৯৯তম ম্যাচে উইকেট পাওয়ার পর
ইডেনে সচিন। ছবি: উৎপল সরকার।
আঠারো বছরের বিবাহিত জীবন তাঁদের। আজ পর্যন্ত অঞ্জলি তেন্ডুলকরকে কেউ কখনও ক্রিকেট মাঠের খোলা গ্যালারিতে দেখেনি। মাঠে থেকে সচিনের ক্রিকেট দেখা যদি দর্শকের চোখে সূর্যালোক হয়, তা হলে অঞ্জলি হলেন সচেতন অসূর্যম্পশ্যা। দু’রকমের ব্রত অবলম্বন করে এত বছর চলেছেন। সচিনের খেলা দেখতে কখনও যান না। আর ইন্টারভিউ দেন না। ইন্টারভিউ না দেওয়ার কারণ প্রচারের আলোয় প্রচণ্ড অস্বস্তিবোধ করেন। আর মাঠে না যাওয়ার পিছনে মারাত্মক কুসংস্কার। তাঁর ভয়, মাঠে ঢুকলেই কোনও না কোনও ভাবে তাঁর উপস্থিতির কথা জেনে যাবেন সচিন। আর অতি সচেতন হয়ে যাবেন। পারফরম্যান্সে প্রভাব পড়বে।
মেলবোর্নে দশ বছর আগে এক বারই সচিনের ব্যাটিং দেখতে সাহস করে ঢুকেছিলেন। গ্যালারিতে নয়, বক্সে। কয়েক মিনিটের মধ্যে হেঁটে বেরিয়ে যান স্বামীকে এক বলে আউট হয়ে যেতে দেখে। তার পর থেকে সচিন ক্রিজে থাকলে অঞ্জলির রুটিন হল, বাড়িতে নির্দিষ্ট একটা জায়গায় বসে থাকা। কোনও ফোন না নেওয়া। কারও সঙ্গে কথা না বলা। এক পা-ও নড়াচড়া না করা। এমনকী ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখতেও তিনি যাননি। ছেলে অর্জুনকেও বারবার বারণ করেছিলেন, “তোমায় যদি এক বার মাঠের স্ক্রিনে দেখায়, ভাবতে পারছ বাবা কতটা চাপে পড়ে যাবে?” এ দিনও ইডেনে বসে বলছিলেন, ‘অর্জুনটা কিছুতেই আমার কথা শুনল না। সেই গেল। ভাগ্যিস ওরা বিশ্বকাপটা জিতেছিল।”
এ হেন অঞ্জলি ইডেনের লোয়ার টিয়ারে বসে টেস্ট ম্যাচ দেখছেন, দাদর আর বান্দ্রায় তাঁর প্রতিবেশীরা ছবি দেখলেও বোধহয় বিশ্বাস করবেন না। মজার কথা, ইডেনে তাঁর বুধবারের ক্রিকেট ডে আউট-ও সম্পূর্ণ স্বামীকে না জানিয়ে। মঙ্গলবার রাত দশটা নাগাদ সচিন তাঁর সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে শুতে যান। এক বার জিজ্ঞেসও করেন, “কানাঘুষো শুনছি, তুমি নাকি ইডেনে খেলা দেখতে আসছ?” অঞ্জলি উত্তর দেন, “কী যে বলো তুমি? এ-ই তো শুতে যাচ্ছি।” এর পর ভোর চারটেয় উঠে ছেলে আর বন্ধুদের নিয়ে উড়ে আসেন কলকাতায়। এয়ারপোর্টে নেমেই তাঁর প্রথম প্রশ্ন ছিল, “ইন্ডিয়া কি ব্যাট করছে?”

খেলা দেখতে সিএবি বক্সে অঞ্জলি। বুধবার শঙ্কর নাগ দাসের তোলা ছবি।
ধোনি টস হেরে ফিল্ডিং করছেন জেনে অঞ্জলি হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। ভারত ও সচিন ব্যাট করলে সেই সময়টুকু তিনি মাঠের ধারকাছ মাড়াতেন না। “অসম্ভব, ও ব্যাট করলে আমি সামনে বসে দেখতে পারব না।” চা-বিরতির পর যখন ক্রমান্বয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ উইকেট পড়ছে, অঞ্জলি ভেবে পাচ্ছেন না এ বার তিনি কী করবেন। এক্ষুনি তো ভারত ব্যাট করবে! আর দ্রুত যদি দু’টো উইকেট পড়ে যায়?
ততক্ষণে লোয়ার টিয়ার থেকে অঞ্জলিরা সিএবি-র বক্সে ফেরত। ভারতীয় ইনিংস এ বার শুরু হবে। তেন্ডুলকর-পত্নীর চোখেমুখে টেনশন। হঠাৎ অর্জুন ছুটতে ছুটতে এসে বলল, “বাবা ওপেন করবে তো?” অঞ্জলি বললেন, “ইয়ার্কি মারছিস নাকি? এটা কি টি-টোয়েন্টি, না ওয়ান ডে?” অর্জুন তাতেও অবিচলিত, “তাতে কী আছে? একটু তো ভেবে দেখতে পারে? বদলাক না ব্যাটিং অর্ডার?” অঞ্জলি বললেন, “দেখছেন তো, আমাকে নিয়ে কী রকম ঠাট্টা করছে? আমার প্রেশারটা জানে বলে এ সব করছে।”
সিএবি বক্সে তখন অঞ্জলিকে সৌজন্য জানাতে ঢুকেছেন জগমোহন ডালমিয়া। সচিনের ১৯৯তম টেস্টে ভিভ-ওয়ার্ন-সোবার্সের মতো অনেক বিশিষ্ট অতিথিকে আনার চেষ্টা করেও সফল হয়নি ডালমিয়ার সিএবি। কিন্তু অঞ্জলি এমন এক্সক্লুসিভ অতিথি এবং এঁকে যেহেতু ক্রিকেট মাঠে কখনও দেখা যায় না, তাঁর আগমনে মুম্বইকে বিরাট চ্যালেঞ্জে ফেলল কলকাতা।
ডালমিয়া বললেন, “অনেক ধন্যবাদ আসার জন্য।” অঞ্জলি তখন অন্য কিছু বলতে চান। “স্যার, ফার্স্ট উইকেটটা পড়লে আমি কি আপনার ঘরে ঢুকে যেতে পারি? আমি এখানে বসে থাকতে পারব না। বড়জোর আপনার ঘরে বসে টিভি-তে দেখব।” ডালমিয়া হেসে বললেন, “কালকের দিনটাও থাকুন। এখানে বসেই সচিনের সেঞ্চুরিটা দেখবেন।” অর্জুনও বলল, “মা, থাকি না আমরা?” অঞ্জলি ওই চাপ নিতে কিছুতেই রাজি নন। বললেন, “রাত্তিরের ফ্লাইটের বোর্ডিং কার্ড সঙ্গে নিয়ে এসেছি। এখান থেকেই সোজা এয়ারপোর্ট।” ফিরে গেলেনও। কিন্তু তার আগে তিনি যখন বক্সে বসে, তখনও নিশ্চিত হতে পারছেন না, সচিন কি তাঁর উপস্থিতির কথা টের পেয়েছেন? তাঁকে কি স্পট করেছেন?

হঠাৎ দেখা ভিভিএস লক্ষ্মণের সঙ্গে! অঞ্জলির কাছে জানতে চাইলেন,
কেমন ব্যাট করছে অর্জুন। বুধবার ইডেনে। ছবি: গৌতম ভট্টাচার্য।
স্থানীয় বন্ধুরা বললেন, “ইম্পসিবল, অত ভিড়ের মধ্যে আপনাকে দেখবে কী করে? তা ছাড়া টিভি ক্যামেরাম্যানকেও তো আপনি সরিয়ে দিলেন।” অঞ্জলি তখন ঘাড় নাড়ছেন, “সচিনকে চেনেন না। অসম্ভব শার্প। যেমন ঘ্রাণশক্তি, তেমনই দৃষ্টিশক্তি। একটা হালকা অ্যানাউন্সমেন্টও হয়েছিল স্কোর বোর্ডে। যদি সেটা দেখে থাকে!” তাঁকে আশ্বস্ত করা হল, সচিন তখন স্কোর বোর্ডের দিকে পিছন ফিরে ছিলেন। জলপানের বিরতি যখন হল,
অঞ্জলি তখন ছিলেন লোয়ার টিয়ারে। ড্রেসিংরুমের দিকে মুখ করে ভারতীয়রা জল খাচ্ছেন। বললেন, “এই বার না আমায় দেখে ফেলে!”
খেলার পর ড্রেসিংরুমের বাইরে স্বামীকে সারপ্রাইজ ভিজিট দিতে গিয়ে শুনলেন, “খুব তো লোয়ার টিয়ারে বসে খেলা দেখছিলে? ড্রিঙ্কসের সময়ই তোমায় দেখে নিয়েছি।” অঞ্জলি তখন লজ্জায় কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। আঠারো বছরের বিবাহিত জীবন ওঁদের। অথচ অঞ্জলির কথা শুনলে মনে হয়, যেন আঠারো মিনিট আগে বিয়ে হয়েছে। অসম্ভব কৃতী ছাত্রী ছিলেন। রেকর্ড মার্কস নিয়ে মেডিসিনে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। কিন্তু স্বামী যাতে ক্রিকেটে পুরো মন দিতে পারেন, তাই ডাক্তারি করলেনই না।
১৮ নভেম্বরের পর আবার কি পেশায় ফেরত যাবেন?
অঞ্জলি বলেন, “তার কী মানে হবে? অ্যাদ্দিন ও বাড়িতে থাকত না। আমি সামলাতাম। এখন ওকে বাড়িতে রেখে আমি বেরিয়ে যাব? হয় নাকি?” অঞ্জলি তেন্ডুলকর অবশ্য স্বীকার করে নিচ্ছেন, ১৮ নভেম্বর-উত্তর জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষার তিনি মুখোমুখি হতে চলেছেন। আচমকা ক্রিকেট ব্যাটের সম্পর্ক-রহিত হতে যাওয়া স্বামীকে তিনি কী করে সন্তুষ্ট রাখবেন?
এরই মধ্যে এক দিন সকালে উঠে সচিন নাকি বলেন, “আজ কি প্র্যাক্টিসে যাব? শেষ তো হয়ে এল!” অঞ্জলি তখন বলেন, “নিশ্চয়ই যাবে।” অস্ফুটে এ দিন বলছিলেন, “খেলুক না খেলুক, আমি চাই ও রোজ প্র্যাক্টিসে যাক। এটা তো বছরের পর বছর ধরে ওর ধর্ম। সেটাকে ছেড়ে থাকবে কী করে?”

আইডলের দৌড়। ছবি: উৎপল সরকার।
ইডেনে তাঁর স্বামীকে ঘিরে প্রাবল্যের বহর খোলা গ্যালারিতে বসে দেখে প্রচণ্ড খুশি। ক্রীড়ামন্ত্রীর কাছে জেনে গেলেন, সিএবি-তে ট্রমা কেয়ার সেন্টার করা হচ্ছে সচিনের নামে। সিএবি-র প্রাক্তন কর্তার মুখে শুনলেন, শেষ দিন স্বামীকে বটগাছের প্রতীক উপহার দেওয়া হচ্ছে। সোনা-রুপো দিয়ে তৈরি সেই বিশেষ উপহারে থাকবে বটগাছের ১৯৯টা পাতা। তিনি যে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের বনস্পতি! ড্রেসিংরুমের বাইরে দেখলেন সচিনের মোমের মূর্তি। হেডেনের মন্তব্য বিশেষ ভাবে লাগানো। ছবি। স্টেডিয়ামের বাইরে কাট-আউট— সব। মুম্বই নিয়ে গেলেন সেই সচিন-মুখোশ, যা তৃতীয় দিন ইডেন-দর্শকদের বিলি করা হবে। সবচেয়ে সুখ আর মাদকতা অবশ্যই ছিল গোটা স্টেডিয়ামের সেই চিৎকার— সা-চি-ন সা-চি-ন। ভারতবর্ষ এর সঙ্গে যৎপরোনাস্তি পরিচিত। অঞ্জলি যেহেতু কোনও দিন খোলা ক্রিকেট মাঠে বসেননি, রেওয়াজি চিৎকারটা এই প্রথম শুনলেন। আর শুনে অভিভূত।
তার রেশ অবশ্য থাকছে না। কেউ না কেউ এসে অবধারিত মনে করিয়ে দিচ্ছে, আপনার স্বামী ক্রিকেট মাঠ থেকে চলে যাওয়া মানে আমাদেরও জীবনে একটা বড় অধ্যায়ের মৃত্যু ঘোষিত হওয়া। কেউ কেউ বলছে, ধুস, আর ক্রিকেট দেখব না। এত বছর সারা পৃথিবী চরকি পাক খেয়ে বেড়িয়েছেন তাঁর স্বামী। এত মিস করেছেন বারবার তাঁকে। ১৮ নভেম্বরের পর সেই স্বামীর এক রকম ঘরে ফেরা।
কিন্তু অঞ্জলি তেন্ডুলকরের সঙ্গে ঘণ্টা তিনেক কাটিয়ে মনে হল, স্বামীর ঘরে ফেরার এমন লগ্নেও তিনি নিশ্চিত হতে পারছেন না, নিজের মনের ভাবটা সত্যি সত্যি কী? সুখী না দুখী?

বোলারের নাম তেন্ডুলকর

ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
টেস্ট-ওয়ান ডে-টি টোয়েন্টি, তিন ফর্ম্যাটের ক্রিকেট মিলিয়ে সচিন তেন্ডুলকর বুধবার তাঁর ২০১ নম্বর উইকেট পেলেন। টেস্টে ৪৬। ওয়ান ডে-তে ১৫৪। টি-টোয়েন্টিতে ১।
টেস্টে তেন্ডুলকরের প্রথম উইকেট মার্ভ হিউজের। ’৯২-এ সিডনিতে।
প্রায় তিন বছর পর তেন্ডুলকর টেস্টে উইকেটে পেলেন বুধবার। ২০১১-র জানুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে কেপটাউন টেস্টের পর।
টেস্টে তেন্ডুলকরের সেরা বোলিং: ইনিংসে ৩ উইকেট তিন বার। তার মধ্যে একবার ইডেনে। ২০০১-এ সৌরভের স্টিভ-বধের টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে। সেরা বোলিং হিসাব ২০০০-এ দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ওয়াংখেড়েতে ৩-১০।
তেন্ডুলকরের খেলা একমাত্র টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ১ উইকেট নিয়েছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার জাস্টিন কেম্পের।
ওয়ান ডে-তে তেন্ডুলকর দু’বার ম্যাচে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন। দু’বারই কোচি-তে। ১৯৯৮-এ অস্ট্রেলিয়া এবং ২০০৫-এ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।

পুরনো খবর:




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.