বিদায়বেলায় রেহাই নেই তুচ্ছ প্লাস্টিকেরও
ক্ষিণ কলকাতার হোটেলে তাঁর যা রুম নম্বর, সেটা আলাদা করে যোগ করলে দাঁড়ায় ১২। পাঁচ তলার সেই ঘরে চেক-ইন করার পর একটা কাজ সচিন তেন্ডুলকর খুব মন দিয়ে করেছেন। তাঁর ব্যাটে স্পনসরের লোগোর ওপর যে ছোট প্লাস্টিক লাগানো রয়েছে, সেটাকে টেনে ছিঁড়েছেন। লাহলিতে যে রঞ্জি ম্যাচ খেলে এলেন, সেই ব্যাটটাও বাড়তি ক্ষতবিক্ষত দেখাচ্ছে একই কারণে। প্লাস্টিকটা ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল বলে। চব্বিশ বছরের ক্রিকেটজীবনে ব্যাটে কত স্টিকার এসেছে, কত গেছে! প্লাস্টিক-টাস্টিক নিয়ে ভাবেনওনি।
চল্লিশোর্ধ্ব সচিন ভাবেন। তাঁর দর্শন বলে, ওই প্লাস্টিকটায় লেগে অতর্কিতে বাউন্সি ডেলিভারি কিপারের হাতে চলে যেতে পারে। বেশি স্পিন করা একটা বল হাল্কা ছুঁয়ে বিপদ ডেকে আনতে পারে। সেই বিপদের আশঙ্কা এক লাখে এক বারও কি না সন্দেহ। কিন্তু বিদায়ী সিরিজে ওইটুকু আশঙ্কাও নিজের পারফরম্যান্স ঘিরে রাখতে রাজি নন তেন্ডুলকর।
মঙ্গলবার দু’দিকের নেটে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেই নকিং করলেন। তার মধ্যে কোনও আশ্চর্য নেই। বরাবরের রুটিন! কিন্তু টেস্ট ম্যাচ শুরুর আগের দিন ডিনারের সময়টাও সেই সওয়া সাতটাই থেকে গেল। কলকাতার যে বাড়ি থেকে সময়-সময় তাঁর খাবার আসে, সেখানে বলে দিলেন, কাল টেস্ট শুরু। অতএব খাবার যেন ঠিক সাতটায় আসে। সচিনের বিশেষত্ব হল, ভারতের যখন যেখানে খেলতে যান, এ রকম কিছু বন্ধু তাঁকে খাবার বানিয়ে পাঠান। আর সেটা টিমের ঘনিষ্ঠ তিন-চার জনের সঙ্গে ভাগ করে খান। আগেকার টিম হলে সেই তালিকায় অবধারিত থাকতেন জাহির-হরভজনরা। এখনকার নতুন দলে সেখানে অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে বিরাট কোহলির।
প্রত্যাশার চাপ থাকলেও তার প্রভাব পড়েনি অনুশীলনে। ম্যাচের আগের দিন
হাল্কা মেজাজে বিরাট কোহলির সঙ্গে। মঙ্গলবার ইডেনে। ছবি: উত্‌পল সরকার।
প্রবাদপুরুষদের ব্যাটন চাইলেই ওই রকম রিলে রেসের মতো এক হাত থেকে আর এক হাতে নেওয়া যায় না। যদি নেওয়া যেত, প্রবাদপুরুষ কথাটাই তো থাকত না। তবু ধরা যাক, তেন্ডুলকর বংশের উত্তরপুরুষ হতে যাচ্ছেন কোহলি। চব্বিশ বছরেরও বেশি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কাটানো, ১৯৯তম টেস্টের একমাত্র পথিকের থেকে তিনি কী শিখলেন?
ক) দু’শোতম টেস্টের মতো ক্লান্তিকর এভারেস্টে পৌঁছেও রিল্যাক্স করতে নেই। অনুশীলনে খামতি দিতে নেই। খেলাটা বড় বিষাক্ত। যখন তখন ছোবল মারতে পারে।
খ) চান্স ফ্যাক্টর সতত বর্জনীয়। যত বয়স বাড়বে, তত তো আরও বেশি করে। লোগোর প্লাস্টিক জাতীয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ঝুঁকিও নিতে নেই।
গ) মাঠের বাইরের শৃঙ্খলা মাঠের মধ্যেকার ব্যাটিংয়ের সঙ্গে যোগ করতে হয়। স্কোর বোর্ডে যে রানটা দেখায়, তার মধ্যে সেই রানের সাবেকি উত্‌পত্তিস্থলটা দেখানো হয় না। কিন্তু এই রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া, টেস্ট ম্যাচের আগের দিন আটটার মধ্যে খাওয়া চুকিয়ে দেওয়া এগুলোও এক-একটা স্কোরিং শট। এগুলোও এক-একটা অদৃশ্য চার-ছয়।
গল্ফগ্রিন থেকে শ্যামবাজার। কেওড়াতলা শ্মশান থেকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস। কলকাতার উত্তর-দক্ষিণ এফোঁড়-ওফোঁড় করে মঙ্গলবার কোথাও মনে হল না, তেন্ডুলকর নামক মহাক্রিকেটমনুষ্য যে এই শহরেই আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঐতিহাসিক ১৯৯তম টেস্ট ম্যাচ খেলতে নামছেন। শহরটা এখনও উত্‌সবের খপ্পরে। অ্যাদ্দিন ছিল দীপাবলি। এ দিন এমনকী কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়াতেও অকৃত্রিম ভাইফোঁটা! ইডেন সংলগ্ন এলাকা দশ কিলোমিটারের ভেতরে হয়েও যেন এক আলাদা উপগ্রহ! ইডেনের মাঠে বরাবরের মতোই উপাসনায় মগ্ন তেন্ডুলকর আর উত্‌সবে ভাসমান গোটা শহর যেন অদ্ভুত বৈপরীত্য।
ভারতীয় ড্রেসিং রুমের বাইরে যেখানে তাঁকে ঘিরে ম্যাথু হেডেনের অমর মন্তব্য আর মোমের মূর্তি গত কাল বসানো ছিল, সেখানে এ দিন দেখা গেল উপহারের ভিড় আরও বেড়েছে। কেক। হিন্দি আর বাংলায় লেখা প্রশংসাসূচক দু’টো বোর্ড। আর সামুদ্রিক মাছে ভরা একটা আস্ত অ্যাকোয়ারিয়াম। জীবজগতে কেউ ১৯৯টা টেস্ট ম্যাচ খেলেনি। তেমনই ক্রিকেট ড্রেসিংরুমের বাইরে অ্যাকোয়ারিয়ামও দেখেনি কেউ।
সচিন বার হলেন টিমের সবার শেষে। দ্রুত বদলে গেল পরিস্থিতি। তাঁকে ঘিরে নব্বই ডেসিবেলেরও অনেক বেশি শব্দদূষণ, ধাক্কাধাক্কি আর বিশৃঙ্খলার মধ্যে তখনই কাছ থেকে মুখটা দেখার সুযোগ পাওয়া গেল। রিল্যাক্সড। গভীর। স্বপ্নালু। এই লোকটির ক্রিকেটজীবনে এমন সৌভাগ্য হয়নি যে, বাইশ গজে কেউ কড়ে আঙুলে টিপ দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছে ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
এই লোকটিকে বরঞ্চ নিজেকেই গ্যালন গ্যালন ঘাম ঝরিয়ে বলতে হয়েছে অনুশীলনের কপালে দিলাম ফোঁটা, বোলারের দুয়ারে পড়ল কাঁটা!
ক্রিকেটজীবন সায়াহ্নেও সেই কঠিন অরণ্যে বসবাস থেকেই গেল। স্থান মাহাত্ম্যে তার চমক আরও আকর্ষক হল এই যা। এমনিতে ইডেন তেন্ডুলকরের প্রিয়তম মাঠ হওয়ার সুযোগ নেই। এর চেয়ে ঢের বেশি সফল তিনি চিপকে। ইডেনও সফলতর ব্যাটসম্যান দেখেছে। লক্ষ্মণ। আজহার। দ্রাবিড়। তবু মাঠটা বৃত্তাকারে চক্কর দিতে গিয়ে দুপুরে মনে হল, তেন্ডুলকরের বিদায়বেলার জন্য এ রকমই আদর্শ অ্যাম্পিথিয়েটারের দরকার ছিল। চিপক বা কোটলা তুলনা নয়। ওয়াংখেড়ে তো নয়ই। দেড়শো বছরের পুরনো ইডেন উদ্যান টেস্ট ম্যাচ দেখছে আশি বছর ধরে। তার ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ম্যাচ অবশ্যই সৌরভদের স্টিভ-বধ। সেরা ইনিংস লক্ষ্মণের ২৮১। সেরা বোলিং পঁচাত্তরে চন্দ্রশেখরের লয়েড-বিজয়। সেরা তাত্‌পর্যপূর্ণ ঘটনা, দক্ষিণ আফ্রিকার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পুনরঅভ্যুদয়। সেরা অভ্যর্থনা আসিফ ইকবালের বিদায়ী টেস্ট ইনিংস। কিন্তু সবচেয়ে বরণীয় আর অমর হিসেবে বোধহয় থেকে যাবে তেন্ডুলকরের ক্রিকেটীয় শেষযাত্রা। হাতে তো থাকল শুধু মুম্বইয়ের পাঁচ দিন।
কেউ কেউ বলছিলেন, খুব রক্ষণশীল গণনাতেও বাংলার অন্তত পনেরো থেকে কুড়ি হাজার লোক ১৮ নভেম্বরের পর আর ক্রিকেট দেখবেন না। ক্রিকেটদর্শক হিসেবে তাঁদেরও অনেকের শেষযাত্রার সূচনা করছে বুধবারের ইডেন। একশো আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির জাদুকরই তো এ বার জাদুতে নিজেকে অদৃশ্য করে দিচ্ছে!
সিরিজের প্রথম টেস্ট ম্যাচ মানে সচরাচর পুজোর সপ্তমী। লোকে অনেক আশার সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে বাকি পুজোর দিকে তাকিয়ে থাকে। অথচ এ বারেরটা যত না উত্‌সবের, তার চেয়ে বেশি যন্ত্রণার। যত না ঝলমলে তার চেয়ে বেশি ছাই চাপা। যত না নীল তার চেয়ে বেশি কালো।
ওহ! ভুলে গেছি, টেস্টটাতে খেলছে ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

পুরনো খবর:




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.