বোধনের ষষ্ঠী সহসা বিজয়ার বিকেল। জানা গেল, সচিন তেন্ডুলকরকে আর ঠিক দু’টো খেলায় দেখতে পাব। শুরু হল প্রস্তুতি। বিদায় সচিন। মুহূর্তে নাকি ক্রিকেটপ্রেমীদের সত্তা অসাড়। সতীর্থরা নতজানু। প্রাক্তনীরা প্রশংসায় ভাষাহীন। ১২১ কোটি বাক্রুদ্ধ।
কিন্তু তা হলে গত দু’বছর ধরে ‘এ বার তোমার যাওয়া উচিত’ বলে আওয়াজ তুলল কারা? যত বার তোমার উইকেট ডিগবাজি খেয়েছে, তত বারই গুঞ্জন উঠেছে, ‘আর চলছে না।’ পঞ্চাশের আগে আউট হলেই লোকে বয়স গুনতে বসেছে। দশ ম্যাচেও একশো না এলে, উড়ে এসেছে টিটকিরি, “এ বার ছেলের সাথে খেলবে।” যদি আজকের কান্না সত্যি হয়, তা হলে কাল পর্যন্ত গাল পাড়ছিল কারা? না কি সেই সব মুখই আজ শোকমিছিলে শামিল? যে ভিড়ে মিশে রয়েছি আমিও! কোনটা আমার মুখ? কোনটা মুখোশ?
এক ঝাঁক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই নিজের কাছে বেআব্রু হয়ে গেলাম। হয়তো আমার মতো আরও অনেকেই। আমি এক নতুন ঘরানার প্রতিনিধি। জীবন এগোচ্ছে কি না, প্রতি মুহূর্তে তা জরিপ করি আমি। জরিপের মাপকাঠি একটাই। কত রান? কটা উইকেট? কিংবা, কী করে? কী চড়ে? মাসের শেষে কত? আমার কাছে তুমি স্রেফ শেষ পাঁচ ম্যাচের রান। ১০, ৫, ৩০, ০, ১৫? তুমি যাও। ৫৫, ১৭৩, ৮০, ১৫০, ৪৫? তোমায় হৃদমাঝারে রাখব।
সাফল্যের ফিতে এমন বদলে গিয়েছে বলেই একটা শব্দ অভিধান থেকে ছেঁটে দিয়েছি আমরা। ধৈর্য। যে মেওয়া সবুরে ফলে, তাতে আমাদের রুচি নেই। সব চাই। এখনই। যে কোনও মূল্যে। চাকরিতে দ্রুত এক ধাপ উঠতে পাশে বসা সহকর্মীর সর্বনাশ করতে হবে? আমি তৈরি। মন্টেসরিতে মেয়ে র্যাঙ্কে নেই। টিউশন চালু সেই সন্ধে থেকেই। আজ মাধ্যমিক শেষ, কাল জয়েন্টের জাঁতা। আজ প্রেম, কাল বিছানা। সারা জীবন শুধু ফাস্ট ফরওয়ার্ড। দ্বিতীয়কে কেউ মনে রাখে না। তোমার খেলা পড়ে আসছিল ঠিকই, কিন্তু আরও বেশি করে নিপাত চাইছিলাম এই গতিসর্বস্ব যুগে তোমাকে বড় বেমানান ঠেকছিল বলে। শৃঙ্খলা, অধ্যবসায়, একাগ্র সাধনা এই সব প্রাগৈতিহাসিক অস্ত্র এখনও? ক্যাচ না-তুলতে প্রায় আড়াইশো রানের ইনিংসে কভার ড্রাইভের লোভ সামলানো? যেমনটা সিডনিতে করেছিলে তুমি! তুমি জানতেই পারোনি কখন আমাদের জীবন টি-টোয়েন্টি বনে গিয়েছে।
প্রায় যে কোনও জিনিয়াসেরই একটা সমস্যা থাকে। তারা জানে, কী দুর্লভ জিনিস হাতে পেয়েছে। তাই ক্ষমতার শেষ বিন্দু পর্যন্ত সে প্রতিভা নিংড়ে দিতে চায় তারা। তাই বার বার মাথা হেঁট হলেও পরের মরসুমের জন্য র্যাকেটে শান দেয় রজার ফেডেরার। মুটিয়ে যাওয়ার পরেও ফুটবলে ফিরতে চায় মারাদোনা। কিন্তু অতি বড় জিনিয়াসেরও সেই নাছোড় লড়াইয়ে আমাদের রুচি নেই। আমরা মেসি-ম্যানিয়া বা রোনাল্ডো-হুজুগে আছি, কিন্তু তত দিনই, যতক্ষণ তারা ফর্মের মধ্যগগনে। আমাদের অনেক বেশি পছন্দ উড়নতুবড়ির মতো চ্যাম্পিয়ন। যারা জলদি জ্বলে, আবার জলদি খতমও। এক মুখ বেশি দিন দেখতে আমাদের ভাল্লাগে না।
আজকাল মনে হয়, তোমার জীবনে সব থেকে বড় আশীর্বাদ বোধহয় তোমার কেরিয়ার শুরুর টাইমিং। কারণ, সেই ১৯৮৯ থেকে যারা তোমার প্রতি দিনের সঙ্গী থেকেছে, তাদের হাতে সময় ছিল বিস্তর। সেঞ্চুরি শেষে তোমার ব্যাট তোলা দেখবে বলে তারা দিনভর টিভি ছেড়ে নড়েনি। গোগ্রাসে গিলেছে ঠুক ঠুক করে চলা টেস্টও। বিশ্বাস হয় না! এরা আজও কিশোরের গানে পাগল। মারাদোনার বাঁ পায়ে মোহিত। বচ্চনের ব্যারিটোনে ফিদা। নেটওয়ার্কিংয়ের প্রয়োজন ছাড়াও এরা এমনি এমনি মানুষের সঙ্গে কথা বলে। ব্ল্যাকবেরির থেকে বেশি পাত্তা দেয় বন্ধুকে। এত সময় আমাদের কোথায়?
তাই তোমার যাওয়াটা ভীষণ জরুরি ছিল। লেখা শুরুর সময় মনে যে বোকা-বোকা দুঃখ ছিল, তা কবেই ফুড়ুত। আমার বুকে এখন একশো ঢাকের বোল। বিসর্জনের। কিন্তু আনন্দের। |