সম্পাদক সমীপেষু...
পুরুষের প্রতি এতটা বিদ্বেষ কেন
তসলিমা নাসরিন-এর প্রাক্দীপাবলি নিবন্ধ (‘পুংপুজো’, রবিবাসরীয়, ২৭-১০) তাঁর এ যাবৎকাল প্রকাশিত রচনাগুলোর মধ্যে পুরুষদের উদ্দেশ্যে গরল নিঃসরণে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পেতে পারে। একটি সিঁদুরে মেঘের আভাস পাই যেন তাঁর কলমে। মনে হয়, ‘রোগ সারাতে হবে’ বলে তিনি স্বেচ্ছাচারিতার ধ্বজা উত্তোলন করছেন না তো?
কৈলাস থেকে উমা আসেন পিতৃগৃহে চার দিনের জন্য। শ্বশুরালয়ে যাবার কালে মন কেমন-করা বিষণ্ণতায় উমাকে বিদায় জানিয়ে মণ্ডপে মণ্ডপে, বারোয়ারিতলায়, পুজোবাড়িতে সধবা মহিলারা একে অপরকে সিঁদুর পরান। সিঁদুর খেলা তখন পারস্পরিক কল্যাণ আদান-প্রদানের ভূমিকা গ্রহণ করে। ঠাকুর বিসর্জনের পর আমরা পুরুষরা যেমন পরস্পর কোলাকুলি করি শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে। এখন ‘সিঁদুর খেলা’ সেলেব্রিটি মহিলাদের জমাটি উপস্থিতিতে বিশেষ কিছু পুজো প্রাঙ্গণ থেকে সরাসরি সম্প্রচার হয়। এ ক্ষেত্রে বিপণন তার ভূমিকা পালন করে। তসলিমা নাসরিন প্রশ্ন তুললেন, স্বামী যাঁদের জোটেনি, বা ‘যাঁদের সিঁদুর মুছে ফেলা হয়েছে’— তাঁদের কেন ‘বারণ’ সিঁদুর খেলায়। এবং, একটাই উদ্দেশ্য তিনি খুঁজে পেয়েছেন। ‘স্বামীর দীর্ঘায়ু’। আলবাত তাই। নিরক্ষর, চাকুরিহীনা বা স্বেচ্ছায় স্বাবলম্বী না-হওয়া মহিলার নির্ভরস্থল তাঁর স্বামী। তসলিমার জানা উচিত, শতকরা নব্বই জন স্বামী স্ত্রীকে পেটান না। তাঁদের সহবাস-জাত সন্তানসন্ততির কল্যাণ কামনাই জাগরূপ থাকে দাম্পত্যে।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে তাঁর প্রশ্ন, কেন বিবাহিত ছেলেরা শাঁখা সিঁদুর লোহা পরছে না? (শাড়িটাও জুড়ে দিতে পারতেন তো।) বিয়েতে স্বামী যখন স্ত্রীকে সিঁদুর পরান, তখন তাঁকে মর্যাদা দান করেন। সসম্মান তাঁকে অর্ধাঙ্গিনীর স্বীকৃতি দেন। বিবাহকে তো আইনানুগ বেশ্যালয় বলেই গিয়েছেন এক জন দার্শনিক। ধরেই নিন, সর্বজনের সম্মতিতে এক জন পুরষ সহবাস করতেন যাঁর সঙ্গে, তিনি তাঁর শাঁখা সিঁদুর পরিহিতা স্ত্রী। কামনা বাসনা চরিতার্থ করতে অতঃপর তাঁর অন্যত্র যাওয়ার প্রয়োজন নেই। অচেনা বা চেনা মেয়েটিকে বিয়ে করলে, তার একটা চিহ্ন চাই।
পুরুষ স্বভাববশে নৃশংস নয়। নারীও সর্বাংশে সর্বংসহা নয়। কত অসহায় পুরুষ প্রতিনিয়ত স্ত্রীর অত্যাচারে নিষ্পেষিত হচ্ছেন, কত সংসার এক জন নারীর খবরদারিতে তছনছ হয়ে গিয়েছে, কত নারী ছেলেমেয়েদের ছেড়ে দিয়ে নতুন সংসার পেতেছেন— তার খবর কে রাখে? আধিপত্য সবাই দেখাতে চায়। সমানাধিকার শ্রেয়। প্রয়োজনে পুরুষও ঘরকন্নার কাজ করতে পারে। তবে প্রয়োজনটা সর্বক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় না। চাকুরিরত পুরুষ ঘরে ফিরে ঘরকন্না করবে? এবং নিছক হাউজওয়াইফ সারা দিন ভ্যারেন্ডা ভাজবে? পি এন পি সি, টিভি সিরিয়ালে মেতে থাকবে? ধর্ষণ খুন করার জন্য পুরুষের আধিপত্যটাকে জোর করে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা অন্যায়। শিক্ষিত শহুরে পুরুষ স্ত্রীকে দাসী মনে করে না। এটা প্রযোজ্য তাদের সম্পর্কে, যাদের স্ত্রীরা হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে বাড়ি ফিরে চুল্লু খাওয়া স্বামীর হাতে মার খায়। এদের ক্ষেত্রেই শিক্ষার প্রসার ও প্রচার দরকার।
নারীও তো এখন পুরুষের মতো প্রায় সর্বক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠিত। তবে কেন এমন অসার বিতর্কের অপচেষ্টা?
তসলিমা নাসরিনকে কিছু খোলা কথা।
‘সিঁদুর খেলা’, ‘করবা চৌথ’, ‘ভাইফোঁটা’, ‘শিবরাত্রি’ ইত্যাদি এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কিছু সামাজিক আনন্দ উৎসব মাত্র। ধর্মীয় কোনও অনুশাসন বা কোনও রকম কোনও ফতোয়ার রক্তচক্ষু এখানে নেই যে, ওই সব অনুষ্ঠানে কোনও নারীকে বাধ্যতামূলক ভাবে উপস্থিত হয়ে পুরুষের মঙ্গলকামনা করতেই হবে। উৎসব আনন্দের মাঝে কোনও নারী যদি অন্তর থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভালবাসায় স্বামী, পুত্র বা ভাইয়ের জন্য প্রার্থনা করেন, তাকে কিন্তু কোনও ভাবেই ‘নারী বিরেধী প্রথা’ বলতে পারেন না।
প্রিয়জনের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করতে কোনও ধর্মীয় আচারের প্রয়োজন আছে কি? প্রার্থনা তো যখন ইচ্ছে যেখানে খুশি করা যায়। আর, সে ক্ষেত্রে নারীর পাশাপাশি এক জন পুরুষও তাঁর প্রিয় মানুষগুলোর সুখ শান্তি সুস্থতার জন্য প্রার্থনা যে করেন না সেটা নিশ্চয়ই আপনি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারেন না।
আপনি নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত সমাজে একটু খোঁজ নিলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখবেন, স্বামী-পুত্র নিয়ে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি-মার্কা ধারণা এখন সমাজে খুব পরিচিত আর স্বীকৃত। আর শাঁখা সিঁদুর লোহা পরার উপদ্রব? অনেক ক্ষেত্রেই এই ব্যাপারেও কোনও সামাজিক অনুশাসন কিন্তু নেই। আপনার চার পাশে এখন শাঁখা সিঁদুর লোহা ছাড়াও অনেক বিবাহিত আধুনিকাকেই দেখতে পাবেন সহজে। খুব দ্রুত বদলাচ্ছে অনেক কিছু। আর তাই দয়া করে অতটা হতাশ হবেন না আপনি।
ধর্ষণ, বধূ নির্যাতন, কন্যাভ্রূণ হত্যা এগুলো এক ধরনের মানসিক বিকৃতির প্রকাশ। এর শিকড় যদি সত্যিই আপনি খোঁজেন তা হলে দেখবেন, এর পিছনে রয়েছে এক চরম ভোগবাদী, জড়বাদী এবং ইন্দ্রিয়সর্বস্ব অন্ধকার সত্তা। এর প্রতিকার হল সমাজের সর্বস্তরে মানবচেতনার বিকাশ, শিক্ষার বিস্তার, মানুষের নিজস্ব গভীরে দেবত্বের জাগরণ এবং আরও আরও বেশি করে প্রেমের প্রসার।
দুর্গা প্রতিমা হল নারীশক্তির এক মূর্ত প্রতীক। তাই আপনি যদি আচার অনুষ্ঠান বা পুরাণ প্রথার কথাই ধরেন, তা হলে কিন্তু বলব যে, বহু প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন রূপে নারীশক্তি বা মাতৃশক্তি পূজিত হয়েছে এখানে। এই ভারতীয় উপমহাদেশে শাস্ত্র, সংস্কৃতি বা সভ্যতায় নারীকে অতি উচ্চ আসনে রাখা হয়েছে অতি প্রাচীন কাল থেকেই।
তসলিমা নাসরিন-এর প্রবন্ধটি পড়ে খুবই বিরক্ত হলাম। সামাজিক উৎসব, পুজো-পার্বণ থেকে শুরু করে সর্বত্রই তিনি এখন পুরুষতন্ত্রের ভূত দেখতে পাচ্ছেন।
এ কথা ঠিকই, সারা পৃথিবীতে নারী অনেক বেশি নির্যাতিত। নারী ধর্ষণ ও নারী হত্যার লজ্জা পুরুষের কম নয়। তবে মুষ্টিমেয় কিছু বিকৃতমনা মানুষের ঘৃণ্য কাজকে কি একটা লিঙ্গ-সমাজের উপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে? পাশাপাশি একটু ভাবুন, নারীর দ্বারা পুরুষ নির্যাতিত নয়?
ভারতীয় সমাজে দেবতার তুলনায় দেবীর পুজো হয় অনেক বেশি। সরস্বতী, দুর্গা, লক্ষ্মী, কালী, জগদ্ধাত্রী, মনসা প্রমুখ দেবী তথা নারী অবয়বকে কেন্দ্র করেই পুজো অর্চনা উৎসব চলে। নারী অত্যাচারিত হত বলেই সমাজের জাগ্রত বিবেক থেকে নানান দেবীমূর্তি-সহ ছিন্নমস্তা কালীমূর্তিও উৎসারিত হয়েছিল। পুরুষ তো কখনও প্রশ্ন তোলেনি, নারীমূর্তিকে কেন্দ্র করে এমন পুজো উৎসব চলবে কেন?
তসলিমা নাসরিনকে বলি, যাঁদের উদ্দেশ্যে আপনার কলম সদাসক্রিয়, আমি সেই নারীজাতির এক জন। আপনার লেখা আমার পছন্দের। তার কারণ যতটা আপনার লিখনশৈলী, ততটাই আপনার চারিত্রিক দৃঢ়তা। পুরুষশাসিত সমাজে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করে চলার জন্য বটেই, আত্মসম্মান রক্ষার জন্যও মেয়েদের মধ্যে যে দৃঢ়তা থাকা জরুরি। ‘আমি পারি’— এই বার্তা সমাজের কানে পৌঁছে দেওয়ার জন্যও। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, সেই দৃঢ়তা তিনি আমার মধ্যেও সঞ্চারিত করেছেন বলে।
কিন্তু একটা কথা বলুন তো, সমাজে যে রীতিগুলো বহু কাল ধরে প্রচলিত, সেগুলো কি এত সহজে মুছে দেওয়া সত্যিই যায়? কারা কোন যুগে সেগুলোর প্রচলন করেছিল বলে আজ আমাদের বেচারা স্বামীগুলোর কান টেনে চাঁটি মারার সত্যিই কি কোনও প্রয়োজন আছে? ওদের কী ক্ষমতা যে, এত কালের সংস্কার প্রতিটি মানুষের মনের গহ্বর থেকে শিকড়সুদ্ধ উৎপাটন করে? তার কোনও প্রয়োজনও তো নেই। কারণ, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে শাসক ও শাসিতের সম্পর্কের চেয়েও অনেক বেশি যেটা থাকে, তা হল ভালবাসা, পারস্পরিক নির্ভরতা, একে অন্যকে ভাল থাকতে দেখার ইচ্ছা। আর এগুলোই হয়তো কারণ। যে জন্য ‘উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষিত স্বনির্ভর মেয়েরা’ স্বামী সন্তানের মঙ্গল কামনায় পালন করছেন নানা ধরনের ধর্মীয় আচার। অমুক পুজো করলে আমার স্বামীর অথবা সন্তানের মঙ্গল হতে পারে। অন্তত না-হলেও কোনও অমঙ্গল হবে না। তবে সেই প্রথা মানতে ক্ষতি কী? এ রকম লক্ষ লক্ষ স্বামীও পাওয়া যাবে যাঁরা, যদি স্ত্রীর মঙ্গলের জন্য কোনও প্রথা থাকত, তা হাসিমুখে পালন করতেন। কিন্তু তেমন কোনও প্রথা সমাজে প্রচলিত নেই। সে দোষ তাঁদের নয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.