প্রবন্ধ ১...
সমাজকে দেখালেই সমাজদর্শন হয় না
নিরুদ্দেশ বাপ জীবিকার খোঁজে ঘুরে বেড়ায়, জানতেও পারে না তার সন্তান মারা গেছে। ঘরে ফিরে দেখে নিজেদের বসতবাড়িতেই প্রায় উদ্বাস্তু জীবন যাপন করছে তার পরিবার। শেষে সে সত্যিই উদ্বাস্তু হয়। সপরিবার।— পথের পাঁচালী মনে পড়ে? এই সমাজবাস্তবতার নিরিখেই সত্যজিতের প্রতিটি ছবিকে ভীষণ ভাবে ‘ভারতীয়’ বলে মনে করেন আদুর গোপালকৃষ্ণন।
আজকাল অবশ্য মুম্বইয়ের হিন্দি ছবিও ‘ভারতীয়’ হয়ে উঠছে, সে সব ছবির প্রতিটি ফ্রেমে সমাজবাস্তবতার ‘রিফ্লেকশন’।— কিন্তু এ কথা মানতে নারাজ আদুর। ব্যতিক্রমী ছবির কথা আলাদা, কিন্তু আমাদের জীবনের সত্য বা বাস্তবতা এ সব ছবিতে সে ভাবে আসে না। একটা ‘সারফেস রিয়েলিটি’ হয়তো ধরা পড়ে, ভারতীয় জীবনের সংকট কোনও গভীরতায় পৌঁছয় না।
ঠিকই, মুম্বইয়ের হালফিল ‘সমাজবাস্তবতা’র নানা ছবিতে সংকটের চেহারাগুলো খানিকটা একই ধরনের ছকে অবসিত। সংবাদপত্রের দৈনন্দিন রিপোর্টের মতো, ছবির চরিত্র ও ঘটনাগুলি একসঙ্গে গ্রথিত হয়েই ক্ষান্ত থাকে। সমাজ আসে অনেকটা গড় চেহারায়, ব্যক্তিমানুষও। এই সব ছবিতে প্রায় কখনওই সংকটগুলো সেই নির্যাস নিয়ে আসে না, যা অর্জন করতে পারলে ছবিগুলোকে ‘ভারতীয়’ বলা যেতে পারে। সেটা সম্ভবত এ জন্য যে, ছবিগুলির স্রষ্টারা জাতির ও দেশের আত্মবিকাশের নানা সমস্যাকে নিজেদের ছবিতে বিষয় হিসেবে ঠাঁই দিতে উৎসাহী থাকেন যতটা, ততটা জিজ্ঞাসু থাকেন না বিষয়টি সম্পর্কে।
চার দশক ধরে নিজের ছবিতে এই ভারতীয়তার প্রসঙ্গ নানা ভাবে পেশ করে চলেছেন আদুর। ইতিহাসের বাঁধা সড়ক থেকে নয়, তার ব্যত্যয় থেকে বিষয় তুলে আনেন তিনি। ইতিহাসের পশ্চাদপসরণ বা অসফলতাই তাতে ধরা পড়ে বেশি। পরাধীন দু’শো বছর আমাদের আত্মপরিচয় অর্জনের প্রক্রিয়াকে জটিল করে ফেলেছে, আজও সে জটিলতা ঘুচবার তেমন কোনও সংকেত নেই। বরং এক অনিবার্য আত্মবৈপরীত্যের দিকে যেন আমরা নিয়ত ছুটে চলেছি।
যেমন তাঁর বছর এগারো আগেকার কাহিনিচিত্র নিঝালক্কুথু-র যে ফাঁসুড়ে চরিত্রটি, সে রাজশক্তির হয়ে কাজ করে, আবার সেই শক্তিকে ভয়ও পায়। পরাধীন সময়ের গল্প। তার ছেলে স্বদেশি, চরকা কাটে। বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে, ছেলেকেই ফাঁসুড়ের ভূমিকায় চলে যেতে হয়। ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে যে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে সরব ছিল, সেই দণ্ড বলবৎ করার কাজ তার পেশা হয়ে ওঠে, ব্রিটিশ রাজশক্তির হুকুমে তাকে নিরপরাধ কাউকে ফাঁসি দিতে হয়। আশির দশকের ছবিগুলির মধ্যে যেমন অনন্তরম। অজয়ন নামের এক তরুণ নিজের প্রতিভা আর মধ্যমেধার দ্বন্দ্বে আত্মপরিচয় হারিয়ে ফেলে। ভুল আইডেন্টিটি-র বশবর্তী হয়ে বিচ্ছিন্ন এক অস্তিত্ব আঁকড়ে ধরে। মুখামুখম-এ ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্তর্দ্বন্দ্ব আখ্যায়িত করতে গিয়ে আদুর যে নেতাকে মূল চরিত্র করে তোলেন, তিনি শুধু ঘুমিয়ে পড়েন আর বড় বড় হাই তোলেন সারা ছবিতে। আশি আর নব্বইয়ের সন্ধিক্ষণে মাথিলুকাল। জেল-জীবন আর বন্দিদের ভালবেসে ফেলেছিল যে স্বাধীনতা সংগ্রামী, তার যখন মুক্তির আদেশ আসে, স্বগতোক্তি করে সে: কোথায় যাব বাইরে, আরও বড় কোনও জেলখানায়? বিধেয়ন বা ‘দ্য সারভাইল’ এমন এক বশ্যতার আখ্যান, যেখানে ব্যক্তির অস্তিত্ব প্রভুত্বের সেবায় আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা।

‘কথাপুরুষণ’ ছবির একটি দৃশ্য
যখনই রাষ্ট্র, সমাজ, বা পরিবার, কিংবা কোনও রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী সন্ত্রাসীর ভূমিকা নেয়, ব্যক্তির নিরাপত্তার প্রশ্নকে বড় করে তোলেন আদুর। কেন? বলেছিলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতার বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে। দেশের গণতন্ত্রের ওপর আমার কোনও আস্থা নেই, এ কথা মোটেও বলব না। গণতন্ত্রের নানাবিধ সুফল তো আমরা পেয়েই থাকি। কিন্তু সমাজে বা সংসারে সমবেত বসবাসের মধ্যে আমরা কখনও কখনও ব্যক্তির ওপর অবিচার করে ফেলি। হয়তো অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার ওপর সমষ্টির মত চাপিয়ে দিই। আরও খারাপ যেটা, এই সমষ্টির প্রতিভূ হিসেবে সরকার যখন তার রাজশক্তি প্রয়োগ করে, পুলিশ-প্রশাসন-আইন-আদালত দিয়ে ব্যক্তির স্বাধীন বাঁচাকে রুদ্ধ করে, সন্ত্রস্ত করে। ব্যক্তির এই মানবাধিকার খণ্ডন সম্পর্কে আমরা যেন ওয়াকিবহাল থাকি, সজাগ থাকি। ছবির ভিতর দিয়ে আমার বলবার কথা শুধু এইটুকুই।’
আঠারো বছর আগে আদুরের কথাপুরুষণ-এ এ রকমই এক চরিত্র ছিল কুনজুনি। জন্ম পরাধীন ভারতে। গাঁধীজির অসহযোগ আন্দোলন আর স্বাধীনতার পর তাঁর হত্যাকাণ্ডের কথা শুনে-দেখে সে বড় হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বাইরের জগতের সঙ্গে তার আদানপ্রদান শুরু হল কমিউনিস্ট রাজনীতির মাধ্যমে। এক সময়ে সে নকশাল আন্দোলনে যোগ দিল। জরুরি অবস্থা, জেলজীবন আর প্রচণ্ড প্রহার পেরিয়ে, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে কুনজুনি যখন আত্মজৈবনিক উপন্যাস লিখল, কেরলের বামপন্থী সরকার সেটি নিষিদ্ধ করল কমিউনিস্ট রাজনীতি নিয়ে বিভ্রান্তিসৃষ্টির অভিযোগে। কুনজুনির আদর্শের রাজনীতি শেষ পর্যন্ত দলীয় ও সরকারি ক্ষমতার প্রতিভূ হয়ে দাঁড়াল। ছবির শেষ দৃশ্যে নিষেধাজ্ঞার কথা শুনে হঠাৎ হাসতে শুরু করে কুনজুনি। বউ আর ছেলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ছড়া কাটে আর গাইতে থাকে। বলে: সত্য তা হলে সরাসরি বলা যাবে না, সত্যকে সব সময় লুকিয়ে প্রকাশ করতে হবে, আড়ালে-আবডালে ঘুরিয়ে বলতে হবে সত্যের কথা, না হলেই শাস্তি! বলতে-বলতে তার আবাল্য তোতলামো সেরে যায়। কুনজুনির ছেলে অবাক হয়ে তার মা’কে বলে: ‘দেখো-দেখো, বাবা কিন্তু আর তোতলাচ্ছে না।’ কুনজুনির এই আকস্মিক তোতলামি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভবত সেই আত্মপরিচয় পাওয়ারই প্রস্তুতি, যার খোঁজে একের পর এক ছবি করে চলেছেন আদুর।
এই আত্মপরিচয়ের খোঁজ থেকেই ভারতীয়তার নতুন পাঠ তৈরি হচ্ছে এখন আদুরের ছবিতে। ২০০৭-এ ফোর উইমেন আর ২০০৮-এ আ ক্লাইমেট ফর ক্রাইম, সাম্প্রতিক দু’টি ছবিই মেয়েদের বেঁচে থাকার নিজস্ব ধরন নিয়ে। এর আগেও তাঁর এলিপাত্থয়ম-এ মেয়েদের সাংসারিক শোষণের রূপটাকে স্পষ্ট করতে তাদের ইঁদুরকলে আটকে পড়াকেই যেন প্রতীকায়িত করেন আদুর।
কিন্তু শুধু শাসন-শোষণে পিষ্ট হওয়া মেয়েদের এই চেহারাটাই এখন আর মুখ্য নয় আদুরের ছবিতে। যেমন তাঁর আ ক্লাইমেট ফর ক্রাইম-এর পাঙ্কি। যে পুরুষ যখন এসেছে তাকে ভালবাসায় ভরিয়ে তুলেছে মেয়েটি, একমুখী আনুগত্যের বদলে পাঙ্কি-র দুই পুরুষের প্রতি সমান প্রেম, এ নিয়ে আদুরের ব্যাখ্যা: সে বাঁচে ‘naturally’. এ-মন্তব্য আরও তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠে ছবির শেষে, যখন দু’জন পুরুষই গিয়ে দেখে পাঙ্কি সপুত্র সহবাস করছে তৃতীয় এক পুরুষের সঙ্গে। কোনও কৈফিয়তে না গিয়ে পাঙ্কি জানায়: এত দিনে কাঙ্ক্ষিত মাতৃত্বের সাধ পূরণ হয়েছে তার। পাঙ্কি-র এই জীবনযাপন প্রচলিত নৈতিকতার বাইরে বেঁচে থাকার নতুন সংজ্ঞা তৈরি করে।
মেয়েদের বেঁচে থাকার এই যে নিজস্ব ধরন, তা কোনও প্রাতিষ্ঠানিকতার কাছেই আত্মসমর্পণ করে না। আইন-আদালত-পুলিশ-প্রশাসন-রাষ্ট্র— কোনও কিছুর কাছেই না। সমস্ত বাধ্যতা, পেষণ, শাসন রুখে দিতে পারে বেঁচে থাকার সেই আবেগ। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা মেয়েদের এই বেঁচে থাকার ধরনকে ‘অসামাজিক’ প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। তাদের ভালবাসা থেকে যে দাম্পত্য জন্ম নেয়, তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এবং, বিয়ের কোনও আইনানুগ প্রমাণ পেশ করতে না পারলে সেই ভালবাসা থেকে সঞ্জাত দাম্পত্যের নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে।
ফোর উইমেন-এ একটি ছবির নাম প্রসটিটিউট। এক তরুণী যৌনকর্মীর পেশা ছেড়ে হাড়ভাঙা খাটুনির কাজ বেছে নেয়, কম রোজগারের জীবন, শুধু তার ভালবাসার মানুষটির সঙ্গে সংসার পাতবে বলে। কপর্দকহীন প্রেমিকটির মাথা গোঁজার ঠাঁই বলতে রাস্তা, আর পেশা বলতে বাড়ির পরিচারকের কাজ। যে মুহূর্তে মেয়েটি অঞ্চলের সমস্ত পুরুষকে শরীর দেওয়ার পেশা ছেড়ে নিজের প্রেমিক-পুরুষটিকে স্বামী বলে ঘোষণা করে, ঠিক তখনই তাদের বিয়ের প্রমাণ চায় আদালত। নিজেদের বারংবার স্বামী-স্ত্রী ঘোষণা করা সত্ত্বেও, আদালত তাদের জেলে পাঠায়— বেআইনি সহবাসের জন্যে, বিয়ে না করার জন্যে।
ক’বছর আগের কথা। গোয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের আন্তর্জাতিক ফিল্মোৎসব ‘ইফি’তে দেখানো হচ্ছে তাঁর পুরনো ছবি বিধেয়ন। ছবি শুরুর আগে ভারতীয় ছবির সমাজবাস্তবতা নিয়ে বলছেন আদুর, ‘সেই বাস্তবতা অনেকটাই জেনেছি সত্যজিৎ রায়-ঋত্বিক ঘটক-মৃণাল সেনের ছবি দেখে।’ শুনতে শুনতে আমার কলকাতার হালফিল তুখড় ছবি-করিয়েদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। জানতে ইচ্ছে করছিল, আদুরের এই দীক্ষা কি এই নবীনদের কাছে কোনও অর্থ বহন করে? তাঁর ছবিগুলি কি তাঁদের কাছে কোনও ভাবেই গ্রহণীয়, না কি পুরোটাই প্রত্যাখ্যাত?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.