মার্কিন ড্রোন হানায় পাকিস্তানের উত্তর ওয়াজিরিস্তানে তেহরিক-ই-তালিবান-এর শীর্ষ নেতা হাকিমুল্লা মেহসুদের নিধন দুই দেশের সম্পর্কে নূতন জটিলতার সৃষ্টি করিয়াছে। পাকিস্তান যথারীতি ‘সার্বভৌমত্বের উল্লঙ্ঘন’-এর চড়া প্রতিবাদ জানাইয়াছে। অনুরূপ প্রতিবাদ ওসামা বিন লাদেনের নিধনকালেও শ্রুত হইয়াছিল। কেন বিন লাদেন বা হাকিমুল্লা মেহসুদের মতো ঘাতক জেহাদিরা পাক ভূখণ্ডে নিরাপদ আশ্রয় পাইবে, সেই অস্বস্তিকর প্রশ্নটি এড়াইয়া গিয়া পাক রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ সেনা-কর্তাদের সুরে সুর মিলাইয়া সার্বভৌমত্ব রক্ষার ধুয়া গাহিয়া দেশপ্রেমের হাওয়া তোলে। তাহাতে অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু যায় আসে না। ইহার পরেও ইসলামাবাদকে ওয়াশিংটনের নিকট হাত পাতিতেই হইবে।
তবে, পাক তালিবানের এই কমান্ডার মারফতই ইসলামাবাদ আফগান তালিবানকে নিয়ন্ত্রণ না হউক, অন্তত প্রভাবিত করার ছক কষিয়াছিল। মার্কিন-বহুজাতিক বাহিনী কাবুল ছাড়িলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হইবে, তাহা ভরাট করিতে তালিবানকে আহ্বান জানাইবার প্রস্তুতি হিসাবে সূচিত আপস-প্রক্রিয়ায় হাকিমুল্লাই হইতে পারিতেন পাকিস্তানের ঘুঁটি। ওয়াশিংটন সেই পাকা ঘুঁটি কাঁচাইয়া দেওয়ায় শান্তি-প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ ইসলামাবাদের পক্ষে অনিশ্চিত হইয়া পড়িল। এখন হাক্কানি গোষ্ঠী মারফত পাকিস্তানকে আফগান তালিবানকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করিতে হইবে। মার্কিন প্রশাসনের পক্ষেও হাকিমুল্লাকে অপসারণের যুক্তি বুঝা কঠিন। সত্য, রসদ সরবরাহের পাক করিডর বন্ধ করিয়া তেহরিক-ই-তালিবানের জেহাদিরা মার্কিন সামরিক অভিযানে নানা বিপত্তি সৃষ্টি করিয়াছে। কিন্তু তুলনায় পাকিস্তানের রাষ্ট্র ও সমাজের বিরুদ্ধে তাহার জেহাদ অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক। পাক তালিবানের ফিদাইন হামলায় পাক সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর সদর দফতর, পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বিধ্বস্ত এবং অগণিত নিরীহ সাধারণ মানুষ হতাহত হইয়াছেন। তথাপি নওয়াজ শরিফের সরকার যে পাক তালিবান নেতৃত্বের সঙ্গেই আপস-রফায় উদ্গ্রীব, তাহার কারণ আমেরিকা-বিযুক্ত কাবুলে আফগান তালিবানকে নিয়ন্ত্রণের অভিপ্রায়। হাকিমুল্লার মৃত্যুতে প্রকল্পটি ধাক্কা খাইল।
এমন হইতেই পারে যে, মার্কিন প্রশাসন তালিবানের শীর্ষ নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করিয়া তাহাকে ভবিষ্যতে কাবুল শাসনের ব্যাপারেও আমেরিকার মুখাপেক্ষী করিয়া রাখিতে চায়। সে ক্ষেত্রে অবশ্য তাহাকে মোল্লা ওমরের মতো নেতাকেও নিষ্ক্রিয় করিতে হইবে। তবে মনে রাখা ভাল, সোভিয়েত-প্রত্যাহার পরবর্তী গৃহযুদ্ধ-দীর্ণ আফগানিস্তানে রাজনৈতিক স্থিতি কায়েম করা কেবল তালিবানের পক্ষেই সম্ভব হইয়াছিল। তাই মার্কিন প্রশাসন যদি তালিবানকেই শাসনভার ন্যস্ত করিতে চায়, তবে তাহার শীর্ষ নেতৃত্বকে অক্ষত রাখাও প্রয়োজন। হাকিমুল্লার বিষয়টি অবশ্য ভিন্ন। ওয়াশিংটনের নিশ্চয় মনে হইয়াছে, আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ শাসনভার বকলমে পাকিস্তানের হাতে তুলিয়া দিলে জেহাদি সন্ত্রাসের এই সূতিকাগারটি আরও দুর্ভেদ্য হইবে। হয়তো সে জন্যই পাক তালিবানকে দুর্বল করিতে উপর্যুপরি ড্রোন-হানা। নির্ভুল লক্ষ্যবস্তুতে দূরনিয়ন্ত্রিত আক্রমণ হানিয়া ভয়ঙ্কর জেহাদিদের খতম করায় এই অভিযানের সাফল্য নজিরহীন। অথচ নৌসেনার কফিনও আর মার্কিন মুলুকে পৌঁছাইতেছে না। ফলে এই হানাদারি লইয়া মার্কিন মুলুকে প্রতিবাদও নাই। ওবামা নিশ্চিন্ত। |