মঙ্গল গ্রহে মিথেন গ্যাস, এবং প্রাণের সম্ভাবনা, আছে কি না, ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইসরো’র কম্পিউটারে সেই তথ্য আসিয়া পৌঁছাইতে অন্তত দশ মাস বাকি আছে। অনিশ্চিত দশ মাস। চল্লিশ কোটি কিলোমিটার পথ পার হইয়া, বহুতর বিঘ্ন সামলাইয়া ভারতীয় মঙ্গলযান সত্যই লাল গ্রহের কক্ষপথে কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপন করিতে পারিবে কি না, ভবিষ্যৎ বলিবে। অতীত বলিতেছে, এখন অবধি যত মঙ্গল-অভিযান হইয়াছে, তাহার অর্ধেক ব্যর্থ। চিন পারে নাই, জাপানও। সফল মঙ্গল অভিযানের কৃতিত্ব কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়ার। এই তালিকায় ভারতের নাম জুড়িবে কি না, তাহা বড় প্রশ্ন। কিন্তু, সেপ্টেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত অপেক্ষা না করিয়াও একটি কথা বলা চলে। শ্রীহরিকোটায় ৫ নভেম্বর ভারত যে ইতিহাস রচনা করিল, তাহার অভিঘাত কেবল অভিযানের সাফল্য দিয়া মাপা যাইবে না। ইহা ভারতের সক্ষমতার ঘোষণা, দেশের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির, কারিগরি বিদ্যার অগ্রগতির প্রমাণপত্র। যে দ্রুত গতিতে, যে ব্যয়সংকোচের মধ্যে ইসরো অভিযানের আয়োজন করিয়াছে, তাহা প্রশংসনীয়।
মহাকাশ-গবেষণা যে কেবলমাত্র বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চা নহে, তাহার বিপুল সামাজিক গুরুত্ব রহিয়াছে, এই কথাটি ইসরো-র চেয়ারম্যান কে রাধাকৃষ্ণন স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন। কাজেই, মহাকাশ-গবেষণা চালাইতে হইবে। সাধ্যের মধ্যে থাকিয়াই আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টা করা যায় কি না, তাহা একটি প্রধান বিবেচ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। ইসরোর মঙ্গল-অভিযান সেই অর্থে একটি মাইলফলক। অভিযানে মোট ব্যয় হইয়াছে মাত্র সাড়ে চারশত কোটি টাকা। একটি মঙ্গল-অভিযানে গড়ে যত খরচ হইয়া থাকে, ইসরো তাহার মাত্র ১৫ শতাংশ ব্যয় করিয়াছে। অন্য দিকে, যেখানে একটি অভিযানের প্রস্তুতিতে গড়ে তিন বৎসর সময় লাগে, সেখানে ইসরো ১৫ মাসে কাজ সারিয়াছে। বস্তুত, ইতিমধ্যেই অহেতুক তাড়াহুড়ার অভিযোগ উঠিয়াছে। অভিযান সফল না হইলে সেই অভিযোগ তীব্রতর হইবে। কিন্তু তাহা আপাতত জল্পনামাত্র। ভারত যতখানি পারিয়াছে, তাহা তুচ্ছ করিবার নহে।
ব্যবসায়িক সম্ভাবনার প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ। ভারত এ-যাবৎ কৃত্রিম উপগ্রহ ও মহাকাশযান প্রেরণ এবং আনুষঙ্গিক কর্মসূচিতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করিয়াছে, তাহা দরিদ্র দেশের সামর্থ্যের তুলনায় কম নহে। স্বভাবতই, ‘অপচয়’-এর প্রশ্নটি বারংবার উঠিয়াছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, এই ব্যয় প্রকৃতপক্ষে এক দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ। এক দিকে, মহাকাশ কর্মসূচি হইতে দেশের প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতার উন্নতি ঘটে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সামগ্রিক চর্চা উৎসাহিত হয়। তাহার মূল্য অপরিসীম। দুই, দূরসংযোগ, টেলিভিশন সম্প্রচার, আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস ইত্যাদি ক্ষেত্রে কৃত্রিম উপগ্রহের ভূমিকা বিরাট। তিন, মহাকাশ প্রযুক্তির একটি আন্তর্জাতিক ‘বাজার’ আছে, এক দেশের উপগ্রহ বা উৎক্ষেপণ কেন্দ্রকে অন্য দেশ অর্থের বিনিময়ে কিনিতে পারে, কিনিয়া থাকে। ইসরো-র বাণিজ্যিক শাখা অ্যানট্রিক্স অনেক বছর ধরিয়া নিয়মিত উপার্জন করিতেছে। মঙ্গলযাত্রা সফল হইলে উপার্জন বাড়িবার সম্ভাবনা প্রবল। মহাকাশ কর্মসূচির ব্যবসায়িক গুরুত্বের অন্য একটি দিকও তাৎপর্যপূর্ণ। মঙ্গলযানের প্রকল্পটি ইসরো-র, কিন্তু মহাকাশযানটির ৮০ শতাংশ যন্ত্রাংশ নির্মিত হইয়াছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থায়। পাঁচ শতাধিক ছোট-বড় সংস্থা প্রকল্পটিতে যুক্ত ছিল। মাত্র পনেরো মাসে যে সম্পূর্ণ মহাকাশযানটি প্রস্তুত করা সম্ভব হইল, তাহার বড় কারণ এই সহযোগিতা। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির মহিমা অবশ্য মহাকাশেই সীমিত নহে। এই অভিজ্ঞতা হইতে সরকার শিখিতে পারে, বাজারকে কাজে লাগাইয়া তথাকথিত জনস্বার্থের কাজগুলি কী ভাবে দ্রুত সারিয়া ফেলা যায়। মঙ্গল অভিযানের ফল যাহাই হউক, এই শিক্ষা কম গুরুত্বপূর্ণ নহে। |