শ্যামপুকুর, এন্টালির পরে এ বার আলিপুর। তিন দিনের মধ্যে তিন বার জনতার হাতে প্রহৃত হল পুলিশ।
আলিপুরের ঘটনাটি ঘটেছে মঙ্গলবার রাতে। পুলিশ জানায়, বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন পর্ণশ্রীর দুই যুবক। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটি ধাক্কা মারে রাস্তার ধারের বাতিস্তম্ভে। তখন মোটরসাইকেল নিয়ে টহল দিচ্ছিলেন আলিপুর থানার এক সাব-ইনস্পেক্টর। দুঘর্টনাটি দেখে গাড়ির আরোহীদের উদ্ধার করতে যান তিনি। পুলিশের অভিযোগ, উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যাওয়ার সময়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়া যুবকেরাই চড়, থাপ্পড় মারতে থাকে ওই সাব-ইনস্পেক্টরকে। পরে অভিযুক্ত দুই যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ।
এর আগে মঙ্গলবার সকালেই জেলে এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে এন্টালিতে পুলিশের সঙ্গে জনতার খণ্ডযুদ্ধ বাধে। জনতার হাতে বেধড়ক মার খান এন্টালি থানার এক কর্মী। রবিবার কালীপুজোর পরের রাতে শব্দবাজি পোড়ানো বন্ধ করতে গিয়েও জনতার হাতে মার খেয়েছিলেন শ্যামপুকুর থানার তিন পুলিশকর্মী।
তবে কি পুলিশের উর্দির প্রতি ভীতি কমছে? পুলিশকে আর সমীহ করছে না মানুষ? জনতার হাতে পুলিশ প্রহৃত হওয়ার পরপর ঘটনায় প্রশ্ন উঠছে তা নিয়েই। এই প্রবণতা দেখে কারও মত, এখনকার পুলিশ সমীহ আদায় করে নিতে অক্ষম। কেউ আবার মনে করছেন, এগুলি নেহাতই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু হঠাৎ কী এমন বদল এল সমাজে যার জেরে পুলিশ তার স্বাভাবিক কাজকর্ম বজায় রাখতে গিয়ে বাধা পাচ্ছে?
সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র মনে করেন, পুলিশকে মানুষ আর বিশ্বাস করছে না। তাই পুলিশ এখন সমীহ আদায় করতে পারছে না। একই সঙ্গে তিনি বলেন, “এটাও ঠিক যে, বিপদে পড়লে সেই পুলিশকেই ডাকতে হয়। সাধারণ মানুষ সে কথা ভুলে যায়।” সমাজে পুলিশের, বিশেষ করে নিচুতলার পুলিশের অবস্থান কী করে উঁচু করা যায়, তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কর্তাদের ভাবতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
একেবারেই ভিন্ন মত কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদারের। তিনি বলেন, “বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনার জেরে এমন ভাবার কারণ নেই যে, পুলিশ আর নাগরিকদের সমীহ আদায় করতে পারছে না। পরপর এক ধরনের কয়েকটি ঘটনা হয়েছে বলেই পুলিশকে আর মানুষ বিশ্বাস করে না, এমন ভাবনা নিরর্থক। তা করা হলে অতিসরলীকরণ হয়ে যাবে।”
ঠিক কী ঘটেছিল মঙ্গলবার রাতে?
পুলিশ জানায়, সওয়া ১২টা নাগাদ আলিপুর থানার সামনে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন ওই দুই যুবক। পুরসভার ৯ নম্বর বরো অফিসের সামনে গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার ধারের ত্রিফলা বাতিস্তম্ভে ধাক্কা মারে। টহলরত ওই সাব-ইনস্পেক্টর দেখেন, অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছেন গাড়ির মালিক তথা চালক রোহিত সাহু ও তাঁর বন্ধু দেবাঞ্জন কুণ্ডু। কিন্তু দুর্ঘটনার তীব্রতায় গাড়িটি দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছে। পুলিশের অভিযোগ, দু’জনেই মত্ত অবস্থায় ছিলেন। তাঁদের থানায় নিয়ে যাওয়ার সময়ে ওই দুই যুবক পুলিশকে চড়, থাপ্পড় মারেন। ধৃতদের ৮ তারিখ পর্যন্ত জেল হেফাজত দিয়েছে আদালত।
পুলিশের একাংশের চিন্তা, বিপদে পড়া মানুষকে উদ্ধার করতে গিয়ে এ ভাবে নিগৃহীত হতে হলে মানুষের জন্য কাজ করার আগে দশ বার ভাবতে হবে। তাঁদের আরও বক্তব্য, আইনের রক্ষককে আইন ভঙ্গকারীদের হাতে বারবার মার খেতে হলে নিচুতলার পুলিশকর্মীদের মনোবল তলানিতে ঠেকবে।
পুলিশ জানিয়েছে, শ্যামপুকুর ও এন্টালিতে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হয়েছিল। ওই দুই জায়গায় পুলিশকে মারধরের ঘটনায় যাঁরা অভিযুক্ত, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের হয়েছে। কিন্তু সকল অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা যায়নি। শ্যামপুকুরের ঘটনায় সাত অভিযুক্তের মধ্যে ধরা পড়েছেন এক জন। এন্টালি থানার ঘটনাতেও একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অিiযaগ রয়েছে। তবে কেউ গ্রেফতার হয়নি।
সংবাদমাধ্যমে এন্টালির ঘটনাটি জেনে রাজ্য মানবাধিকার কমিশন বুধবার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। রাজ্য পুলিশের আইজি (সংশোধনাগার)-কে তদন্ত করে দু’সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলেছে কমিশন। পাশাপাশি, কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার পদমর্যাদার কোনও অফিসারকে দিয়ে তদন্ত করে দু’সপ্তাহের মধ্যে কলকাতার পুলিশ কমিশনারকেও রিপোর্ট জমা দিতে বলেছে কমিশন।
এক পুলিশকর্তা জানান, এন্টালির ঘটনায় মৃত অভিজিৎ পাত্রের ময়না-তদন্ত বলছে, তাঁর ফুসফুস ও হার্ট দুর্বল ছিল। দেহে আঘাতের চিহ্ন মেলেনি। |