যে জমি আন্দোলনের উপর পুলিশি আভিযানকে কেন্দ্র করে রাজ্য রাজনীতি তোলপাড় হয়ে হয়েছিল, সেই লোবা আন্দোলনের এক বছর পূর্ণ হল বুধবার। লোবায় কৃষিজমি রক্ষা কমিটির ধর্না মঞ্চের কাছে আজও একই ভাবে দাঁড়িয়ে খোলামুখ কয়লা খনি গড়তে আসা সংস্থার মাটি কাটার যন্ত্রটি। আন্দোলনের বর্ষপূর্তিকে মনে রেখে হল প্রতিবাদ সভাও। এই মঞ্চ থেকে রাজ্য সরকার জমির ন্যায্য দাম নির্ধারণ ও ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে করতে মধ্যস্থতার দাবি জানানো হয়। সেই সঙ্গে আন্দোলন জিইয়ে রাখার শপথ নিল কমিটি। কমিটির সম্পাদক জয়দীপ মজুমদার বলেন, “দাবি না মেটা পর্যন্ত মানুষের স্বার্থে আন্দোলন চলবে।”
তবে লোবায় প্রস্তাবিত খোলামুখ গড়তে কৃষিজমির বদলে নিজেদের ন্যায্য দাবি ও ক্ষতিপূরণ আদায়ের যে আন্দোলন, কোথাও যেন খানিকটা বদলে গিয়েছে। এর মূলত দু’টি কারণ রয়েছে। প্রথমত খোলামুখ খনি গড়তে আসা সংস্থা-র (পিপিপি ভিত্তিতে গড়া ডিভিসি-এমটা) বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, গত বছর ৬ নভেম্বর পুলিশি আভিযানের পর থেকে সেই সংস্থা আর প্রকাশ্যে নেই। এলাকার জমি কেনাও পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে সংস্থাটি। |
প্রতিবাদ সভা কৃষিজমি রক্ষা কমিটির। বুধবার তোলা নিজস্ব চিত্র। |
দ্বিতীয়ত ভোটে লড়লেও স্থানীয় পঞ্চায়েতের দখল নিতে ব্যর্থ হয় কৃষিজমি রক্ষা কমিটি। ১৪ আসনের লোবা পঞ্চায়েতে ৯টি আসন পেয়ে ক্ষমতায় তৃণমূলই। সেখানে কৃষিজমি রক্ষা কমিটির দখলে মাত্র ২টি আসন। অথচ আন্দোলন ধরে রাখতে ক্ষমতা দখল খুবই প্রয়োজন ছিল। এর পরই কোথাও যেন ফোকাস-টা নষ্ট হয়েছে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল বলেন, “লোবা আন্দোলন কতগুলি স্বার্থান্বেষী মানুষের কাজ ছিল। আমরা মানুষের পাশে আছি, মানুষও আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। তার প্রমাণ লোবা পঞ্চায়েত-সহ দুবরাজপুরের ১০টি পঞ্চায়েত, দুবরাজপুর পঞ্চায়েত সমিতির দখল নিয়েছি।” কৃষিজমি রক্ষা কমিটির নেতারা অবশ্য তা মানতে নারাজ। কমিটির সম্পাদক জয়দীপ মজুমদারের দাবি, “লোবা পঞ্চায়েতের যেখানে যেখানে জমি কিনতে শুরু করেছিল কয়লা খনি গড়তে আসা সংস্থাটি, সেই ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার মানুষ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। পঞ্চায়েতে দু’টি আসন পেলেও ভোট পাওয়ার নিরিখে আমরাই দ্বিতীয় স্থানে।” একই বক্তব্য পিডিএসের রাজ্য সম্পাদক সমীর পুততুণ্ডরও। তিনি বলেন, “আন্দোলন যেমন ছিল তেমনই রয়েছে। তবে পঞ্চায়েত ভোটে আরও কয়েকটা বেশি আসন পেলে তার প্রভাব অন্য রকম হত।”
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর থেকে লোবায় প্রস্তাবিত কয়লা খনি গড়তে আসা ডিভিসি-এমটার মাটি কাটার যন্ত্র আটকে রেখে এগারো মাস ধরে আন্দোলন চালাচ্ছিলেন কৃষিজমি রক্ষা কমিটির সদস্য ও এলাকাবাসী। ওই সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, এলাকার মানুষের সঙ্গে আলোচনা না করে এবং উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন প্যাকেজ ঘোষণা না করেই দালাল মারফত বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু জমি কিনে খননের কাজ শুরু করতে চেয়েছিল ওই সংস্থা। প্রতিবাদে ওই যন্ত্র আটক করা হয়। ওই যন্ত্র উদ্ধারের জন্যই গত বছর ৬ নভেম্বর ভোর রাতে পুলিশি আভিযান হয়। প্রতিরোধ গড়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। সেই সময় গ্যাস, গুলি, তির ও ঢিলে জখম হয়েছিলেন পাঁচ গ্রামবাসী ও ২৭ জন পুলিশকর্মী। বাসিন্দাদের অভিযোগ ছিল, পুলিশের গুলিতে জখম হয়েছেন গ্রামবাসীরা। অন্য দিকে, কৃষিজমি রক্ষা কমিটির তিন নেতা-সহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে পুলিশের উপর সশস্ত্র আক্রমণ, সরকারি কাজে বাধা দান-সহ বেশ কয়েকটি ধারায় জামিন অযোগ্য পাল্টা মামলা করে পুলিশও। সেই মামলা এখনও আদালতের বিচারধীন। এর মধ্যেই কমিটি নতুন করে জমি আন্দোলনকে চাগিয়ে তোলার একটা চেষ্টা করছে বলেই ধারণা অনেকের। তবে সরকার যে এ ব্যাপারে মধ্যস্থতা করবে না, আগেও তা স্পষ্ট করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায়। জেলা সভপতি অনুব্রতও বলেন, “এটা সম্পূর্ণ যে সংস্থা কয়লা খনি গড়বে এবং যাঁদের জমিতে গড়বে সেটা তাঁদের ব্যাপার। আমরা ওখানে দালালি করব না।” এ দিন প্রতিবাদ সভায় সমীর পুততুণ্ড ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “এভাবে একটি দায়িত্বশীল সরকার মানুষকে জমি মাফিয়াদের হাতে ছেড়ে দিতে পারে না। সরকার এগিয়ে না এলে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গার জমি জটের মতো এটাও আটকে থাকবে।”
|