পোলিও টিকা থেকে সম্প্রীতি, শর্ত ইমাম ভাতায়
র নিঃশর্তে ইমাম ভাতা নয়। নির্দিষ্ট কিছু শর্ত মানলে তবেই রাজ্যের ইমাম-মোয়াজ্জিনেরা মাসে মাসে ভাতা পাবেন। এবং সেই সব শর্তের অন্যতম হল পোলিও টিকাকরণে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ। এর সঙ্গে থাকছে আরও কিছু সামাজিক কর্তব্য পালনের শর্ত।
ভাতা-প্রাপকদের কাছে সম্পূর্ণ শর্তাবলি পাঠিয়ে মাসিক রিপোর্ট তলব করেছে রাজ্য ওয়াকফ বোর্ড। তলবি চিঠিতে বলা হয়েছে, কোন ইমাম বা মোয়াজ্জিন মাসে ক’টি শিশুকে পোলিও টিকা খাইয়েছেন বা অন্যান্য টিকাকরণে সাহায্য করেছেন, তার বিবরণ দিতে হবে রিপোর্টে। এ ছাড়া বাড়ির পরিবর্তে প্রসবের জন্য ক’টি মহিলাকে সরকারি হাসপাতালে পাঠিয়েছেন, কন্যাশ্রী এবং অন্যান্য সরকারি প্রকল্প নিয়ে সংখ্যালঘু এলাকায় কতটা কী প্রচার করেছেন, সবই লিখিত আকারে সরকারের কাছে জমা দিতে বলা হয়েছে ইমাম-মোয়াজ্জিনদের। এমনকী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় সারা মাসে কী কী কাজ করেছেন, তা-ও সরকারকে জানাতে হবে ভাতা-প্রাপক ইমামদের।
ভাতায় হঠাৎ শর্ত কেন?
রাজ্যের সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের কর্তাদের বক্তব্য, ইমাম-মোয়াজ্জিনদের তো ধর্মীয় নেতা হিসেবে ভাতা দিচ্ছে না সরকার। কলকাতা হাইকোর্টে মামলায় রাজ্য সরকার হলফনামা দিয়ে জানিয়েছে, পোলিও দূরীকরণ, প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের হার বৃদ্ধি, সামাজিক সদ্ভাব বজায় রাখার ক্ষেত্রে ইমামেরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন। তাঁরা যাতে আরও বেশি মাত্রায় সামাজিক কাজকর্মে যুক্ত হন, সেই ব্যাপারে উৎসাহ দিতেই ভাতা দেওয়া হচ্ছে। আর এখন শুধু চাওয়া হচ্ছে সেই সামাজিক কাজের খতিয়ানটুকুই।
ওয়াকর্ফ বোর্ডের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে স্বাস্থ্য দফতরও। এক স্বাস্থ্যকর্তা জানান, কলকাতার তিলজলা, তপসিয়া, গার্ডেনরিচ, মেটিয়াবুরুজ; দক্ষিণ ২৪ পরগনার আক্রা, মহেশতলা, মগরাহাটের বড় এলাকা; হাওড়ার ডোমজুড়; পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া, কাঁথির কিছু অঞ্চল; মুর্শিদাবাদ, মালদহ-সহ সীমান্তবর্তী আট জেলায় প্রতি বারেই পোলিও টিকাকরণে বাধার মুখে পড়তে হয় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের। অনেক জায়গায় মসজিদের ইমামদের সহায়তা মেলে ঠিকই। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে ইমামদের ফতোয়ার জেরেই পোলিও টিকা খাওয়ানো যায় না। এক স্বাস্থ্যকর্তার কথায়, “আশা করা হচ্ছে, সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতর এখন ইমাম ভাতার সঙ্গে পোলিও টিকারণ-সহ বিভিন্ন সামাজিক কাজের শর্ত আরোপ করায় পরিস্থিতির উন্নতি হবে।”
সরকারেরই একটি মহলের মত, হাইকোর্ট ধর্মের ভিত্তিতে ভাতা বিলি বেআইনি বলে রায় দিয়েছে। তার পরেও ওয়াকফ বোর্ডকে অনুদান দিয়েছে সংখ্যালঘু দফতর। সেই টাকাতেই ভাতা চালু রাখা হয়েছে। এখন সরকার প্রমাণ করতে চায়, ইমামদের সামাজিক কাজের মূল্য হিসেবেই ভাতা দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ আইনগত দিকটি ঠিক রাখতেই এই ধরনের রিপোর্ট চাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আসল লক্ষ্য, আদালতের রায়ের পরেও ইমাম ভাতা চালু রাখা।
ইমামেরা ভাতার শর্ত মানবেন কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। সংখ্যালঘু নেতাদের একাংশ মনে করেন, ইমাম কখনও কারও চাকরি করতে পারেন না। শর্তসাপেক্ষে ভাতা নেওয়াও ধর্মীয় ভাবে স্বীকৃত নয়। ওয়াকফ বোর্ড যে-ভাবে শর্তসাপেক্ষে ইমাম ভাতা দিচ্ছে, তা ইমামদের আচরণবিধির সঙ্গে খাপ খায় না।
কী বলছে ওয়াকফ বোর্ড?
বোর্ডের চেয়ারম্যান, বিচারপতি আব্দুল গনি জানান, আপাতত ইমামদের রিপোর্ট পেশ করতে বলা হয়েছে। রিপোর্ট পাঠানো বাধ্যতামূলক করা হবে কি না, বোর্ডের বৈঠকে সেই সিদ্ধান্ত হবে। তবে ওই রিপোর্টের ভিত্তিতেই ইমামদের ভাতা বাড়ানো-কমানো হতে পারে। গনি বলেন, “যে-সব ইমামসাহেব ঠিক তথ্য-সহ রিপোর্ট দেবেন, তাঁদের ভাতা বাড়বে। যাঁরা যথাযথ রিপোর্ট দেবেন না, তাঁদের ভাতা কমতেও পারে।”
ইমাম-মোয়াজ্জিনদের ভাতার সঙ্গে কিছু দায়বদ্ধতা যুক্ত করা নিয়ে হইচইয়ের কোনও কারণ আছে বলে মনে করেন না গনি। তাঁর ব্যাখ্যা, ভাতার টাকা দিতে হচ্ছে ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তির আয় থেকে। সেই জন্যই ভাতা-প্রাপক ইমাম মোয়াজ্জিনদের কিছু কাজ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ তো আছেই। সেই সঙ্গে এলাকা-ভিত্তিক ওয়াকফ সম্পত্তির খতিয়ান, তার ক’টি বেদখল হয়ে গিয়েছে, ক’টি এখনও বোর্ডের তালিকাভুক্ত হয়নি (ইসি নম্বর হয়নি), সবই জানাতে বলা হয়েছে ইমামদের। ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যান মনে করেন, এলাকায় মাদ্রাসা বা স্কুলছুট হওয়ার প্রবণতা রুখতে ইমামদের ভুমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়েও প্রতি মাসে নির্দিষ্ট তথ্য পাঠাতে হবে তাঁদের। ইমাম-মোয়াজ্জিনদের জানাতে হবে, প্রতি মাসে তাঁরা এলাকায় ক’টি বাড়ি ঘুরে এই সব কাজ করেছেন।
বোর্ডের নতুন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সংখ্যালঘু সংগঠনগুলির মতভেদ প্রকট। কিছু সংখ্যালঘু সংগঠন এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ। যেমন সারা বাংলা সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ কামরুজ্জামানের বক্তব্য, সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বা শিক্ষা প্রসারে ইমামেরা ভূমিকা নিতে পারলে ভালই। তবে ওই রিপোর্টে ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে যে-তথ্য দিতে বলা হয়েছে, ইমামদের পক্ষে সেই কাজ করা সম্ভব নয়। বেদখল ওয়াকফ সম্পত্তি উদ্ধার করতে বলে তো ইমাম-মোয়াজ্জিনদের হাতে আইন তুলে নিতে বলা হচ্ছে। ওয়াকফ সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও উদ্ধারের কাজে প্রশাসন ও পুলিশ তা হলে কী করছে? তাঁর সাফ কথা, “আমাদের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের কেউ এই রিপোর্ট পাঠাবেন না বলে ঠিক করেছেন।” ভাতা নিয়ে আদালতের রায়ের পরে ১৮টি সংখ্যালঘু সংগঠন নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিল কামরুজ্জামানদের ফেডারেশন।
সারা বাংলা ইমাম-মোয়াজ্জিন কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ইস্তিকার হোসেন অবশ্য ওয়াকফ বোর্ডের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “ইমামেরা পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারে নামলে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচার করলে মুসলিম সমাজেরই উপকার হবে। ইমামেরা যদি এলাকার ওয়াকফ সম্পত্তির অবস্থা সম্পর্কে বোর্ডকে অবহিত করাতে পারেন, বোর্ড সে-দিকে নজর দিতে পারবে।” তাঁদের সংগঠনের ইমাম-মোয়াজ্জিনদের নিয়মিত ওই রিপোর্ট পাঠাতে বলা হয়েছে বলে জানান ইস্তিকার।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.