হেরোইন মাফিয়ারদের ঘাঁটি হিসেবে উত্তরপ্রদেশের বরাবাঁকি, মধ্যপ্রদেশের মনসোর এবং রাজস্থানের কোটার পাশপাশি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তালিকায় উঠে আসছে রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা, নদিয়ার কালীগঞ্জ এবং উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁর নাম। কেন্দ্রীয় সংস্থা নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোর (এনসিবি) তথ্যের ভিত্তিতে ওই তালিকা তৈরি হয়েছে। শুধু লালগোলা বা কালীগঞ্জ নয়, তেহট্ট ও পলাশিপাড়া ব্লকেও মাদক মাফিয়ারা সক্রিয়, বলে জানিয়েছেন এনসিবি কর্তারা।
এনসিবি কর্তাদের মতে, ভিনরাজ্যের হেরোইন কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয়েছে এ রাজ্যের পোস্তচাষিদের। লালগোলা-পলাশি এলাকার গ্রামে গ্রামে তৈরি হয়েছে হেরোইন তৈরির কারখানা। তৈরি হচ্ছে ব্রাউন সুগারও। গোয়েন্দাসূত্রে খবর, রাজ্যের সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলায় মাদক মাফিয়াদের দাপট বেড়েছে। বীরভূম ও বাঁকুড়া জেলাতেও সক্রিয় তারা।
গত রবিবার সন্ধ্যায় মুর্শিদাবাদের লালগোলা থানার রামনগর ঘাট লাগোয়া সীমান্ত আউটপোস্ট থেকে ১৬০০ গ্রাম হেরোইন-সহ দু’জনকে গ্রেফতার করে মুর্শিদাবাদ পুলিশ। ধৃতদের নাম জাহাঙ্গির কবির ও ওবাইদুর রহমান। তারা বাংলাদেশে ওই হেরোইন পাচার করছিল। তাদের জেরা করে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছে মুর্শিদাবাদ পুলিশ। সূত্রের খবর, মজিবর নামে আরও এক হেরোইন তৈরির কারিগর ওই এলাকায় সক্রিয়। তার খোঁজে তল্লাশি চলেছে। মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বলেন, “মাদক পাচার রুখতে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
এনসিবির দেওয়া হিসেবে রাজ্যে প্রায় ১০ হাজার একর জমিতে পোস্ত চাষ হয়েছে। পোস্ত চাষ সম্পূর্ণ বেআইনি। রাজ্য পুলিশের সাহায্য নিয়ে এনসিবি এখনও অবধি প্রায় পাঁচ হাজার একর জমির পোস্ত গাছ কেটে দিয়েছেন। বিভিন্ন থানায় প্রায় ৪০টি এফআইআর হয়েছে। পোস্ত চাষিদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে।
এক বিঘা জমির পোস্ত থেকে প্রায় পাঁচ কিলোগ্রাম আফিম হয়ে থাকে। বাজারে এক কিলোগ্রাম আফিমের দাম প্রায় ৫০ হাজার টাকা। এনসিবি-র যুগ্ম অধিকর্তা আর কে সাহু জানিয়েছেন, চাষিরা যাতে পোস্ত চাষ না করেন, সে কারণে স্থানীয় স্তরে প্রশাসনের কর্তারা পঞ্চায়েত সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে প্রচার করেছেন। এ ছাড়া প্রতিটি জেলাশাসককে বিষয়টি নজরে রাখতে বলা হয়েছে রাজ্য প্রশাসনের তরফ থেকে। জেলাশাসকেরা এ বিষয়ে নোডাল অফিসার। তাঁরাই এই অভিযান চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, “বনগাঁ, লালগোলা ও পলাশিতে মাদক-মাফিয়ারা ঘাঁটি বানিয়েছে। অভিযান চালানো হচ্ছে।”
এনসিবি কর্তাদের মতে, ভৌগোলিক কারণে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ওই সমস্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে যাওয়া খুব সহজ। পাশাপাশি মায়ানমারে তৈরি হওয়া হেরোইন ওই পথেই দেশে ঢুকছে। শুধু লালগোলা বা পলাশি নয়, মাদক-মাফিয়ারা সক্রিয় বনগাঁ অঞ্চলেও। বছর খানেক আগে ওই এলাকার মাদক ব্যবসায়ী বিমল মণ্ডলের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে চোখ কপালে উঠেছিল এনসিবি-র কর্তাদের। সেখান থেকে বেশ কয়েক কিলোগ্রাম হেরোইন উদ্ধার করার পাশাপাশি কারখানার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এ ছাড়া লালগোলা এলাকা থেকে আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাবু নামে এক কারিগরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। মাদক-মাফিয়াদের কাছে বাবু পরিচিত ‘ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে।
বাবুকে গ্রেফতারের সময়ে কয়েক কিলোগ্রাম আফিম, বেশ কয়েক লিটার রাসায়নিক, ওজনের যন্ত্র, বেশ কিছু যন্ত্রপাতি ও খালি প্যাকেট পাওয়া গিয়েছিল। শুধু বাবু নয়, ওই এলাকা থেকে হেরোইন মাফিয়া আনোয়ার খান, আজিজুল শেখ, রবিউল শেখ, গোলাম মুস্তাফি, রেজাউল করিমকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, মালদা এলাকার চাষিরা মাদক মাফিয়াদের প্রলোভনে পা দিয়ে বেআইনি ভাবে পোস্তচাষ করছেন। পোস্তফলের গা চিরে বের করা হচ্ছে আঠা। তা থেকে তৈরি হয় মরফিন। সেই মরফিন গ্রাম থেকে সংগ্রহ করছে মাফিয়াদের এজেন্টরা। তা থেকে বেশ কিছুটা মরফিন চলে যাচ্ছে বরাবাঁকি, মনসোর, কোটা এলাকায়। বাকি মরফিন থেকে হেরোইন তৈরি হচ্ছে মুর্শিদাবাদের লালগোলা ও নদিয়ার পলাশি লাগোয়া এলাকায়। ফলে ওই এলাকার যুবকদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে এই মারণ নেশা।
কী ভাবে মরফিন থেকে তৈরি হচ্ছে হেরোইন? এনসিবি-র আধিকারিক জানিয়েছেন, হেরোইন তৈরি করতে বিশেষ কোনও যন্ত্রের প্রয়োজন হয় না। পোস্তর ফল চিরে যে আঠা পাওয়া যায় তা রোদে শুকোনো হয়। তার পরে সেই আঠাকে জলে গুলে বের হয় মরফিন। সেই মরফিনে মেশানো হয় চুন। তার ফলে বিশেষ যৌগ তৈরি হয়। এর পরে সেই যৌগে মেশানো হয় অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড ও সোডিয়ামের এক রাসায়নিক। তবে হেরোইন তৈরিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অ্যাসেটিক অ্যানহাইড্রেড নামে একটি রাসায়নিক যৌগের। বাজারে তা সহজলভ্য নয়। খোলাবাজারে ওই যৌগ বিক্রি করা একেবারে বেআইনি। কিন্তু মাদক মাফিয়াদের দৌলতে তা পৌঁছে যাচ্ছে সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত গ্রামের দোকানেও।
লালগোলা বা পলাশি এলাকায় যে হেরোইন তৈরি হচ্ছে তাতে মেশানো হচ্ছে নানা ধরনের ঘুমের ওষুধ। এ ছাড়া মেশানো হচ্ছে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট। আর এই ভেজাল ব্রাউন সুগার মাদকাসক্তদের কাছে আসায় তাঁদের শরীরে নানা উপসর্গ দেখা দিয়েছে।
এনসিবি-র কর্তারা আর পুলিশ-প্রশাসন নিয়মিত অভিযান চালিয়ে মাদক মাফিয়াদের গ্রেফতার করার চেষ্টা করছেন। কয়েকটি ক্ষেত্রে সফল হচ্ছেন। তবে অনেক সময়ে প্রত্যন্ত এলাকার খবর তাঁরা পাচ্ছেন না। এ ছাড়া এক শ্রেণির পুলিশের সঙ্গেও মাফিয়াদের যোগাযোগ রয়েছে বলেও অভিযোগ করছেন এলাকার বাসিন্দারা।
সব মিলিয়ে সীমান্তে রমরমা মাদক-মাফিয়াদের। |