এ দেশের শহরে গড়পড়তা প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করেন, বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা বেশি নির্ভরযোগ্য।
অন্তত কয়েক বছর আগের তথ্য তা-ই বলছে। মানুষের ধারণা তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকেই তৈরি হয়।
বিশ্বজিৎ মণ্ডল |
ভারত সরকারের পরিসংখ্যান ও যোজনা রূপায়ণ মন্ত্রকের আওতায় জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থা (এন এস এস ও) প্রত্যেক দশকে একটি করে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমীক্ষা করে থাকে। শেষ সমীক্ষাটি হয়েছে ২০০৪ সালে, যেটার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৬ সালে। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সমীক্ষা চালায়, যেটাকে বলে জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা (এন এফ এইচ এস)। এন এফ এইচ এস-এর সর্বশেষ সমীক্ষা প্রায় একই সময়ের। পরবর্তী সমীক্ষার সময় আসন্ন। তার আগে একটু ফিরে দেখা যাক, কয়েক বছর আগে আমাদের পরিস্থিতিটা ঠিক কেমন ছিল। স্বাস্থ্যের নানা দিক রয়েছে: সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক। রিপোর্টগুলিতে সমস্ত দিকগুলি নিয়ে পর্যালোচনার অবকাশ থাকলেও এখানে আমরা শুধু এমন একটি অংশ নিয়ে আলোচনা করব, যেটা দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ভীষণ জরুরি। |
পরিষেবা। সরকারি হাসপাতাল, বীরভূম। ছবি: অনির্বাণ সেন |
স্বাস্থ্য পরিবেশের ব্যাপারে দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরিষেবা প্রদানকারী এবং অর্থ সংস্থানকারী সরকারি না বেসরকারি হবে, সেটা নির্ধারিত হয় এর পরিপ্রেক্ষিতে। ভারতের মতো দেশে যেখানে বহু মানুষ দরিদ্র, সরকারের নৈতিক দায়িত্ব হল বিনামূল্যে বা স্বল্প ব্যয়ে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া। বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান ভাল কি মন্দ, থাকা উচিত কি অনুচিত, সেটা আমাদের বিচার্য বিষয় নয়। আমরা এখানে বোঝার চেষ্টা করব যে সাধারণ মানুষ জনগণ অসুস্থতার সময় কোথায় যায়, কেন যায় বা কেন যায় না। ভবিষ্যতে নীতি নির্ধারণে যে সমস্ত বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া আশু প্রয়োজন, সেগুলি কী কী। আমরা এন এস এস ও এবং এন এফ এইচ এস-এর দেওয়া কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্যের সাহায্যে বিষয়গুলি বোঝার চেষ্টা করব।
সারা দেশে গড়পড়তা প্রায় ৭০ শতাংশ শহরের মানুষ বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবাকে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে ভাবে। গ্রামে সংখ্যাটা একটু কম হলেও সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থার মধ্যে অসামঞ্জস্য সহজেই চোখে পড়ে। এর অন্যতম কারণ, গ্রামে বেসরকারি হাসপাতাল বা ডাক্তারের অপ্রতুলতা।
আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি ব্যবস্থার উপর নির্ভরতা বাড়বে, সেটা হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু চোখে পড়ার মতো ব্যাপার যেটা, সেটা হল, যাদের আয়/সম্পদের পরিমাণ খুব কম, তাদেরও দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ সরকারি ব্যবস্থায় ভরসা পায় না।
গ্রাম-শহর মিলিয়ে সারা ভারতে প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষ সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা নেয় না। সংখ্যাটি নীতি-নির্ধারকদের মাথাব্যথার যথেষ্ট কারণ হওয়া উচিত। এবং, মাত্র কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে চিত্রটা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে একই রকম। ব্যতিক্রম হল সিকিম (৮.২%), মিজোরাম (৯.৪%), হিমাচল প্রদেশ (১৭.৩%) অরুণাচল প্রদেশ (১৭.৫%), ওড়িশা (২৪%), ত্রিপুরা (২০%)। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বিহারে (৯৩.৩%)। লক্ষণীয়, কেরলের ছবিটিও কিন্তু যথেষ্ট ভাল নয় (৫০%)। পশ্চিমবঙ্গের হাল সর্বভারতীয় গড়ের চেয়ে কিছুটা খারাপ ৭১ শতাংশ মানুষ সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা নেয় না।
এর কারণগুলি অনুমান করা কঠিন নয়। যারা স্বাস্থ্যকেন্দ্র/হাসপাতালে যায় না, তারা কিছু আশঙ্কাবশত যায় না। অসুস্থতা নিয়ে কোনও রকম পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টা না করে তারা তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের সাহায্য সিদ্ধান্ত নেয় সরকারি না বেসরকারি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খারাপ পরিষেবাকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয়। তার সঙ্গে রয়েছে সবচেয়ে নিকটবর্তী সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালের দূরত্ব। একমাত্র সিকিমকে বাদ দিলে বেশির ভাগ রাজ্যের মানুষ এই দূরত্ব নিয়ে একেবারেই সন্তুষ্ট নন। সর্বভারতীয় গড় হিসেবে, ৪৬.৮% মানুষ দূরত্বের কারণেই সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা নেন না। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে অনুপাতটি আরও বেশি: ৫৪.৩%। এর চেয়েও খারাপ অবস্থা মাত্র তিনটি রাজ্যের: ওড়িশা (৬১%), ঝাড়খণ্ড (৫৫.৩%) এবং ছত্তীসগঢ় (৫৬.৪%)।
খারাপ পরিষেবার আশঙ্কায় যারা সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যায় না, সর্বভারতীয় হিসেবে তাদের অনুপাত ৫৭.৭%। পশ্চিমবঙ্গ তুলনায় ভাল (৪১.৪%)। গুজরাতের উন্নয়ন নিয়ে প্রচুর উন্মাদনা থাকলেও, গুজরাত (৪২.৬%) কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় পিছিয়ে। উল্লেখ্য, যারা সরকারি পরিষেবা গ্রহণ করে, তারা কিন্তু যথেষ্ট সন্তোষজনক পরিষেবা পায় বলে দাবি করে। একটু পরেই আমরা সে বিষয়ে আলোচনা করব।
রুগিকে নিয়ে কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, সে ব্যাপারটিও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে। তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, এই বিষয়টি সর্বাপেক্ষা বেশি মানুষকে (৫৭.৪%) প্রভাবিত করে দিল্লির ক্ষেত্রে। পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাও ভাল নয় (৩৫.২%) জাতীয় গড়ের (২৪.৮%) বেশ উপরে। উপরে আছে কেরল (৩৪.২%), গুজরাত (৩১.৬%), তামিলনাড়ুও (৩২.৩%)। জনসংখ্যার অনুপাতে (প্রতি হাজারে) হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা ডাক্তারের সংখ্যা এ ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা নিতে পারে।
পাশাপাশি, যে কারণে অপেক্ষারত সময় দীর্ঘায়িত হতে পারে, সেটা হল, স্বাস্থ্যকর্মীর অনুপস্থিতি। এ বার বরং সে দিকে নজর দেওয়া যাক। জাতীয় গড় হিসেবে প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ এটাকে কারণ হিসেবে মনে করলেও, পশ্চিমবঙ্গ (৪.৩%), দিল্লি (২.৩%), তামিলনাড়ু (৩%), সিকিম (৪.৭%), গোয়া (৪.৪%) ও মহারাষ্ট্রে (৫.৩%) আর কম মানুষ এ ব্যাপারটিকে কারণ হিসেবে মনে করেন। এর অর্থ ভয়ঙ্কর। স্বাস্থ্যকর্মী থাকেন, ডাক্তারবাবু থাকেন, তবুও প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষ, যাঁরা সরকারি পরিষেবা নেন না, তাঁরা মনে করেন যে, গিয়ে কোনও উপকার হবে না। অর্থাৎ, লোকজন থাকলেও হয়তো তাঁরা কাজ করেন না বা কাজ করার মতো পরিকাঠামো নেই, বা রুগির চাপ এতটাই বেশি যে যথাসময়ে চিকিৎসা পাওয়ার সম্ভাবনা কম। এ ধরনের অবিশ্বাস যে একেবারেই অমূলক, তা বলা যায় না। কারণ, যুক্তিনির্ভর ক্রেতা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের উপর ভিত্তি করেই নির্বাচন করেন কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয়। স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে এই নিয়মের ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়, বরং এটা আরও বেশি সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হয়, কারণ স্বাস্থ্য পরিষেবা মানুষের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে, সেখানে সময় ও সিদ্ধান্ত অমূল্য।
তবে হ্যাঁ, ১৫-৪৯ বছর বয়সিদের মধ্যে যাঁরা স্বাস্থ্য পরিষেবা গ্রহণ করেছেন, তাঁরা কিন্তু বেশির ভাগ স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজ ও আচরণ নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট। শিক্ষাগত মান, ধর্ম, জাতি, আয়-ভিত্তিক কিছু তারতম্য থাকলেও গড়ে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ মেনে নিয়েছেন যে, চিকিৎসা-সংক্রান্ত ব্যক্তিগত গোপনীয়তা দারুণ ভাবে মেনে চলা হয়েছে। প্রায় ৬২ শতাংশ মনে করেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতালগুলি বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এ ক্ষেত্রে শতকরা পরিমাণ মোটামুটি সন্তোষজনক হলেও আরও উন্নতির অবকাশ রয়েছে। কারণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব কিছু রোগ সংক্রামিত হবার আশঙ্কা বৃদ্ধি করে। আর একটি উৎসাহব্যঞ্জক তথ্য হল, মোটামুটি ৯৫ শতাংশ রোগী মনে করেন, স্বাস্থ্যকর্মী বা ডাক্তারবাবুরা তাঁদের সঙ্গে যথেষ্ট সহায়তা করেছেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে এটি অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয় হওয়া উচিত।
কিছু ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, পরিষেবা কেন্দ্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তফাত না থাকলেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নিরিখে পার্থক্য বেশ লক্ষণীয়। বেসরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে প্রায় ৭১% মানুষ মনে করেন খুব ভাল, সেখানে সরকারি হাসপাতালের অবস্থা নিয়ে মাত্র ৪৫% মানুষ খুশি। এটা মানুষের সরকারি হাসপাতালের প্রতি বিমুখ হওয়ার অন্যতম কারণ হতেই পারে।
মনে করিয়ে দেওয়া ভাল, এই আলোচনা গত দশকের মাঝামাঝি সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে। এ দশকে এ ধরনের সমীক্ষার সময় আসন্ন, তার কিছু দিন পর জানা যাবে, কোথায় কতটুকু উন্নতি বা অবনতি হল।
|
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আলবনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক |