পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর শাসনপ্রণালীতে, চালচলনে, কথাবার্তায় ইদানীং কিছু সদর্থক পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলিতেছে। জমি-জেদ এখনও দুর্মর বটে, কিন্তু শিল্পায়ন বিষয়ে তিনি অনেক বেশি উৎসাহ দেখাইতেছেন। পার্বত্য দার্জিলিঙে তাঁহার শাসননীতি নরমে-গরমে হিংসা ও অস্থিরতার শক্তিগুলিকে সংযত করিয়া শান্তি ও স্থিতির বাতাবরণ সৃষ্টিতে সহায়ক। বাসভাড়া-বৃদ্ধির বিরুদ্ধে তাঁহার অকারণ জেদও যেন কিছুটা শিথিল, পরিষেবা উন্নত করার স্বার্থে ভাড়া বাড়িলে বুঝি আর আগের আপত্তি বহাল নাই। ক্রমশ উন্মোচিত এই পরিবর্তনের নিরিখেই বঙ্গবাসীর মনে কিঞ্চিৎ আশা জাগিয়াছিল, নূতন বছরটি হয়তো মুখ্যমন্ত্রী শুরু করিবেন কর্মসংস্কৃতির নূতন আবহ রচনার মাধ্যমে। যেমন তিনি বলিতে পারিতেন, সরকারি ছুটির দিন কমাইয়া কাজের দিন বাড়াইতে হইবে। কিন্তু অন্য অনেক ব্যাপারে তাঁহার পরিবর্তমানতা সরকারি কর্মচারীদের আলস্যের সুযোগ প্রসারিত করার প্রশ্নে থমকিয়া গেল। নূতন বছরটি শুরুই হইতে চলিয়াছে ছুটির দিন দিয়া।
পালাপার্বণে নাগাড়ে ছুটি ঘোষণা করিয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার গোটা শরৎকালটিকেই ছুটির মরসুমে পরিণত করিয়াছিল। দুর্গোৎসবের পর লক্ষ্মীপূজা ও ঈদের ছুটির মাঝখানে কোনও ফাঁক থাকিলে তাহা ভরাট করিয়া নাগাড়ে দশ দিন সরকারি দফতর বন্ধ রাখার নজিরবিহীন প্রশাসনিক নীতি গৃহীত হয়। লাল ফিতার ফাঁসে যে সরকারের দীর্ঘসূত্রিতা প্রবাদপ্রতিম, এই নীতি তাহার কাজ না করিবার মানসিকতাকে আরও বেশি করিয়া তোষণ করিবে। আগামী বছরগুলিতে এ বছরের নজির দেখাইয়া ওই টানা ছুটির ব্যবস্থা তো থাকিতেছেই, উপরন্তু যে-সব দিনের ছুটি রবিবার কিংবা অন্য ছুটির দিনে পড়ায় ‘মার যাইবে’, সেগুলিও পুষাইয়া দিবার ব্যবস্থা থাকিবে। তাহার পরের বছরও আবার আগের বছর ভোগ করা ছুটি কাড়িয়া লওয়ার বিরুদ্ধে সওয়াল করিয়া ‘মার যাইতেছে না’ এমন ছুটির দিনের পাশাপাশি আগের বার ‘মার গিয়াছিল’ এমন ছুটির দিনও অধিকন্তু সংযোজিত হইবে। এই ভাবে চলিতে থাকিলে একটা বিষয় ক্রমশ নিশ্চিত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যদি তাহার পূর্বসূরির ন্যায় দীর্ঘমেয়াদি হয়, তবে সরকারি দফতরে ছুটির সংখ্যা জ্যামিতিক প্রগতির হারে বাড়িতে বাড়িতে তাহা বছরের ৩৬৫ দিনই বন্ধ পড়িয়া থাকিবে। মুখ্যমন্ত্রী তখন নিত্য দিন কোন নবান্নে বসিবেন?
একটা সময় ছিল, বছর তিনেক আগেই, যখন রাজ্যে সরকারি ছুটির দিন ছিল সাকুল্যে ২৭টি। আগামী বৎসরের জন্য সংশোধিত ছুটির তালিকায় সরকারি কর্মবিরতির দিন ৩১টি। ইহাতে হয়তো ছুটিপ্রিয় কর্মীদের রাজনৈতিক সমর্থন পাওয়া সহজ হইবে, কিন্তু রাজ্যের কর্মসংস্কৃতির সর্বনাশ হইয়া যাইবে। সর্বোপরি একটা নূতন বছরই যদি ছুটি দিয়া সূচিত হয়, তবে বছরভর কাজ করিবার প্রেরণা আসিবে কোথা হইতে? এই সিদ্ধান্তের মধ্যে মানসিকতার যে সমস্যা রহিয়াছে, তাহা কোনও আস্ফালন কিংবা বক্তৃতাবাজিতে ঘুচিবার নয়। এখনও সময় আছে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁহার দেওয়া ‘উপহার’-এর অবিমৃশ্যকারিতা পুনর্বিবেচনা করুন। পরিবর্তনের স্লোগান দিয়া সরকার গড়িয়াছেন তিনি, অধুনা সেই স্লোগান কিছুটা অন্তত রূপায়িত হইবার সুলক্ষণও মিলিতেছে। নূতন বছর শুরু হউক এক নূতন স্লোগান তুলিয়া। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করুন: ‘ছুটি কম, কাজ বেশি’। |