রবিবার সন্ধে পৌনে ৭টা। হাওড়া স্টেশনের নিউ কমপ্লেক্সের ২১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে পৌঁছয় ডাউন ইস্পাত এক্সপ্রেস। অন্য যাত্রীদের সঙ্গে ট্রেন থেকে নামেন তিনজন বয়স্কা মহিলা। দু’জন সত্তরের উপরে। এক জন ষাটের কাছাকাছি। তিন জনেই ওঠেন
পাশেই ক্যাবওয়েতে অপেক্ষায় থাকা নিজেদের গাড়িতে।
বঙ্কিম সেতুর দিকে গাড়ি কিছুটা এগোতেই আলো আঁধারি পথে যেন রাস্তা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে তিন মূর্তি। এক জন লম্বা। দু’জন বেঁটে। এক জনের পরনে পুলিশের খাকি পোশাক। হাত দেখিয়ে গাড়ি থামিয়ে প্রায় ১০ মিনিট ধরে চলে তিন প্রবীণ নাগরিককে নানা ভাবে হেনস্থা। প্রথমে তিন জনের টিকিট দেখতে চায় আগন্তুকরা। এর পর চাওয়া হয় তাঁদের ‘সিনিয়র সিটিজেন’-এর প্রমাণ পত্র। কিন্তু ভোটার কার্ডের ফোটোকপি দেখিয়েও পার মেলেনি। চাওয়া হয় আসল ভোটার কার্ড। গাড়ি থেকে ওই বয়স্কা যাত্রীদের নেমে আসতেও বলা হয়। এ ভাবে হেনস্থা হতে দেখে শেষে সব থেকে বয়স্কা মহিলা বলতে বাধ্য হন, এ বার তিনি তাঁর সাংবাদিক পুত্রকে ফোন করে ঘটনাটা জানাবেন। মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে যায় পরিস্থিতি। “আপনাদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে সিনিয়র সিটিজেন, আপনারা যান,” বলেই রণে ভঙ্গ দেয় তিন জন।
যাত্রী হেনস্থার এটাই প্রথম বা শেষ ঘটনা নয়। অভিযোগ, এ রকম ঘটনা নিত্য দিন ঘটে চলেছে দেশের অন্যতম সুরক্ষিত রেল স্টেশন হাওড়া স্টেশনে। আর এটা ঘটছে হাওড়া স্টেশনের নিউ কমপ্লেক্স এলাকা জুড়ে। বেছে বেছে হেনস্থা করা হচ্ছে দুরপাল্লার যাত্রীদের। কাউকে বাংলাদেশি হিসেবে চ্যালেঞ্জ করে অথবা কারও টিকিট বা বয়সের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে। যেমন করা হয়েছিল গত ২৭ তারিখ। ওই তিন বয়স্কা মহিলার ক্ষেত্রে।
গত বছর চাহিদা মতো ৫০০ টাকা না দেওয়ায় শ্রীরামপুরের এক যুবককে ২২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে আরপিএফ-এর একটি অফিসে আটকে রেখে দিনভর বেদম পেটানোর অভিযোগ উঠেছিল। ট্রেন থেকে নামার পরই তাঁকে ধরা হয়েছিল প্রতিবন্ধী আসনে বসেছিল, এই অভিযোগে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পরে ওই ঘটনায় তিন আরপিএফ জওয়ানকে সাসপেন্ড করতে বাধ্য হন আরপিএফ কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ উঠেছিল, কয়েক জন আরপিএফ জওয়ানের মদতে যাত্রীদের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরেই চলছে নিউ কমপ্লেক্স চত্বরে। ধৃত তিন জন জওয়ান ছিল ওই চক্রের মাথা। স্টেশন চত্বরে আর যাতে এমন ঘটনা না ঘটে সে জন্য বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আরপিএফ-এর গোয়েন্দা দফতরের অফিসারদের।
তবে কি ওই চক্র ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে?
উত্তর হল, হ্যা। যাত্রীদের ভয় দেখিয়ে, হেনস্থা করে টাকা আদায়ের একটি চক্র ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কার মদতে চলছে এ সব, তা নিয়ে রেল পুলিশ ও রেলরক্ষী বাহিনী দায় চাপাচ্ছে একে অন্যের ঘাড়ে।
রেলরক্ষী বাহিনীর দাবি, স্টেশন চত্বরে একটা ‘ডাকপার্টি’ তৈরি হয়েছে। ডাক শব্দের অনেক অর্থের মধ্যে একটি হল, শিবের অনুচর। সম্ভবত নন্দী-ভৃঙ্গীদের অকাজ-কুকাজের কথা মাথায় রেখেই এই নাম। এঁরা যাত্রীদের ধরে নিজেদের জিআরপি-র লোক বলে পরিচয় দিয়ে ভয় দেখিয়ে টাকা তুলছে। রেল পুলিশের আবার দাবি, আরপিএফ-এর লোকজনও তো নিজেদের রেল পুলিশের লোক বলে পরিচয় দিয়ে টাকা তুলতে পারে। এটা প্রমাণ করবে কে? তা ছাড়া রেল পুলিশের কোনও ডাকপার্টি নেই। এই চাপানউতোরে একটি বিষয় স্পষ্ট। তা হল, আরপিএফ এবং জিআরপি দু’পক্ষই মেনে নিচ্ছে যে, স্টেশন চত্বরে ফের যাত্রীদের হয়রান করে টাকা আদায়ের চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
প্রশ্ন হল কারা রয়েছে এই চক্রে?
রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, এই দলে রয়েছে স্টেশন চত্বরে কাজ করা কিছু লাইসেন্সহীন কুলি ও এলাকার কিছু দুষ্কৃতী। কী ভাবে কাজ করে এই ডাকপার্টি? তিনটি দলে ভাগ হয়ে এরা দিনেরাতে ২৪ ঘণ্টা ধরেই কাজ করে। দলে রয়েছে অন্তত ৩০-৪০ জন। থাকে সাদামাটা পোশাকে। কেউ কেউ খাকি উর্দিতে। দূরপাল্লার ট্রেন থেকে যাত্রীরা নামার পর থেকেই তাঁদের ওপর নজরদারি শুরু হয়। খোঁজা হয় কারা দুর্বল নিশানা। প্রথমে টিকিট দেখতে চাওয়া হয়। এর পর বয়সের প্রমাণপত্র। প্রয়োজন হলে তল্লাশির নামে চলে ব্যাগপত্র ঘাঁটাঘাঁটি। এর
পর কোনও ছুতোয় থানায় ধরে
নিয়ে যাওয়ারও ভয় দেখানো হয়। যাত্রীরা এতে ভয় পেলেই শুরু হয় টাকা-পয়সা নিয়ে দর কষাকষি। দলটি ব্যাগ ছিনতাই, পকেটমারি, এমনকী গাড়ির ডিকি থেকে মাল হাপিস করতেও সিদ্ধহস্ত।
জিআরপি-র একাংশ বলছে, এই দলে বা এদের পিছনে তাদের কেউ নেই। কিন্তু আরপিএফ-এর গোয়েন্দাদের দাবি, ওই ঘটনার পর কয়েক দিন ধরে ক্যাব রোড এলাকায় নজরদারি চালিয়ে গত বুধবার রাতে ডাকপার্টি চক্রের ১১ জনকে আটক করা হয়। যার মধ্যে ৬ জন স্টেশন চত্বরের পুরনো অপরাধী। রেলরক্ষী বাহিনীর দাবি, ধরা পড়ার পর ওই দুষ্কৃতীরা নিজেদের রেল পুলিশের নিয়োগ করা লোক বলে দাবি করে। এমনকী, তাদের দাবি সত্য প্রমাণ করে, রেল পুলিশের এক কনস্টেবল ধৃতদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য দরবারও করতে আসেন আরপিএফ দফতরে।
ক্যাব রোড এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত আরপিএফ-এর হাওড়া গুডস শেডের আইসি সঞ্জয় তিওয়ারি বলেন, “নিউ কমপ্লেক্সে এ ভাবে টাকা আদায়ের ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। আমরা রেল পুলিশের কর্তাদের জানিয়েছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।” সঞ্জয়বাবুর বক্তব্য, স্টেশনের ভিতরে হওয়া
সমস্ত রকম অপরাধ ও অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করা ও গ্রেফতার করার আইনি ক্ষমতা রয়েছে রাজ্য সরকারের
ওই সংস্থার হাতে। সেখানে আরপিএফ কী করবে?
হাওড়ার রেল পুলিশ সুপার মিলনকান্ত দাস বলেন, “এই ধরনের ঘটনার লিখিত অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। এটা অত্যন্ত অপরাধমূলক ঘটনা। রেল পুলিশের কেউ জড়িত বলে পাওয়া গেলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” |