ছাত্রাভাবে কার্যত ধুঁকছে বর্ধমান জেলার বেশ কিছু প্রাথমিক স্কুল। তাদের মধ্যে একটি বড় অংশে আবার প্রথম শ্রেণিতে কোনও পড়ুয়াই ভর্তি হয়নি। এই স্কুলগুলির ভবিষ্যৎ নিয়ে পর্যালোচনা শুরু করেছে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ। সম্প্রতি জেলা স্কুল পরিদর্শকদের নিয়ে বৈঠকও করেছেন প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি দেবাশিস নাগ। তিনি বলেন, “স্কুল পরিদর্শকদের (এসআই) কাছ থেকে প্রতিটি চক্রের ধুঁকতে-থাকা স্কুলগুলির নাম ও ছাত্র সংখ্যার তালিকা চাওয়া হয়েছে। তা আসার পরে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ফের আলোচনা হবে।”
বেশ কয়েক বছর আগে পড়ুয়ার সংখ্যা কম বলে বর্ধমান জেলায় বেশ কয়েকটি স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার পরে সর্বশিক্ষা অভিযান চলেছে, মিড-ডে মিল প্রকল্প চালু হয়েছে। তবু প্রাথমিক স্কুলের ক্ষেত্রে ছবিটা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিক স্কুলে চারটি শ্রেণি মিলিয়ে ছাত্রসংখ্যা কুড়িরও কম, এমন স্কুলের সংখ্যা পঞ্চাশের কাছাকাছি। আবার কুড়ি থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে পড়ুয়া রয়েছে এমন স্কুলের সংখ্যাও প্রায় চল্লিশটি। বলা যেতে পারে, এই স্কুলগুলির ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ওই স্কুলগুলির ‘প্রাণ বাঁচাতে’ শিক্ষকেরা ছাত্রসংখ্যা বেশি দেখিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সংসদে রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন বলেও একটি সূত্রের দাবি।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, আগে স্কুল বন্ধের সমস্যা দেখা দিয়েছিল প্রধানত আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল এলাকায়। সেই সময়ে এই এলাকায় ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, বেসরকারি স্কুল এবং শহরের বদলে-যাওয়া জনবিন্যাসকেই এর কারণ বলে দেখানো হয়েছিল। কিন্তু এ বার মূলত গ্রামীণ এলাকায় ছাত্রাভাব দেখা যাচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামেও একই সঙ্কটের চিত্র। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের এক সদস্যের মতে, “পড়াশোনার পরিবেশ সরকারি স্কুলগুলিতে না থাকার ফলে অভিভাবকেরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক স্কুলে পাঠাতে চাইছেন না।”
সর্বশিক্ষা অভিযানের ফলে স্কুল ভবনগুলির শ্রী ফিরেছে, ছাত্রছাত্রীদের পৃথক শৌচাগার হয়েছে, পানীয় জলের বন্দোবস্ত হয়েছে। তা হলে এই রকম অবস্থা হওয়ার কারণ কী? বর্ধমান জেলার এক স্কুল পরিদর্শক বলেন, “গ্রামীণ এলাকায় স্কুলের জায়গা রয়েছে বা গ্রামবাসীরা স্কুলের জন্য জায়গা দান করেছেন। তার ফলে সর্বশিক্ষা অভিযানের টাকা কাজে লাগানো গিয়েছে। সেখানে শহরে অন্ধকার ও স্যাঁতসেঁতে ঘরে পড়ুয়াদের বসতে হচ্ছে। ভাড়া বাড়িতে স্কুল হচ্ছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কি কেউ যেতে চায়?”
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ সূত্রে জানা যায়, ৫৯টি চক্রের মধ্যে চিত্তরঞ্জন, দুর্গাপুর ১ ও ২, জামুরিয়া ১, পাণ্ডবেশ্বর, পূর্বস্থলী (উত্তর) চক্রে কুড়ির কম ছাত্রসংখ্যা নেই বলে প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে। জানা গিয়েছে, দামোদর, অজয় বা ভাগীরথীর ভাঙনের কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। সেখানে স্বাভাবিক ভাবেই ছাত্রসংখ্যা কমে গিয়েছে। এ রকম চিত্র দেখা যাচ্ছে কাটোয়া পূর্ব চক্রের চরবিষ্ণুপুর কিংবা পূর্বস্থলীতে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা স্কুল শিক্ষা কমিটির এক আধিকারিকের কথায়, “শহর এলাকায় প্রতিটি পাড়ায় স্কুল রয়েছে। তার ফলেও এই ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে।” তবে প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি দেবাশিসবাবু মনে করেন, শহর ছাড়িয়ে গ্রামীণ এলাকাতেও বেসরকারি স্কুলের রমরমার কারণে এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শিক্ষকরা জানাচ্ছেন, ছাত্র নেওয়ার জন্য বেসরকারি স্কুলের কর্তৃপক্ষ বাড়িতে গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এ দৃশ্য প্রত্যন্ত গ্রামেও দেখা যাচ্ছে। জেলা স্কুল পরিদর্শক মৃণালকান্তি মুখোপাধ্যায় জানান, “পুরো বিষয়টি আমরা পর্যালোচনা করে দেখছি।” |
দুর্দশার সম্ভাব্য কারণ |
• গ্রামীণ এলাকাতেও বেসরকারি স্কুলের রমরমা। ছাত্র টানতে বাড়ির দোরগোড়ায় গাড়ি।
• ভাঙনের কারণে এলাকা ছাড়ায় জনবসতি কমে যাচ্ছে।
• প্রত্যন্ত গ্রাম ছেড়ে এলাকার বেশির ভাগ বাসিন্দা স্থানীয় জনবহুল এলাকা বা শহরে ভিড় জমাচ্ছেন।
• শহর এলাকায় জায়গার অভাবে মান্ধাতার আমলের স্কুলেই পড়াশোনা।
• পড়াশোনার পরিবেশের অভাব। |
|