আর্থিক প্যাকেজ, মেট্রোর ভাড়া বৃদ্ধি, গোর্খাল্যান্ডের সঙ্গে এ বারে যোগ হল আধার কার্ডের ভিত্তিতে রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি। আরও একটি ময়দানে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি পেতে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থাগুলিকে আধার কার্ডের প্রতিলিপি দেওয়ার (বা তার নম্বর জানানোর) শেষ দিন ছিল বৃহস্পতিবার। অর্থাৎ, কাগজেকলমে শুক্রবার থেকে কলকাতা, হাওড়া ও কোচবিহার জেলায় এই ভিত্তিতে গ্যাস-গ্রাহকদের ভর্তুকি দেওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। কাগজেকলমে, কারণ, এর পরেও তিন মাস সময় পাবেন গ্রাহকরা তাঁদের গ্যাস ডিস্ট্রিবিউটারকে আধার নম্বর দেওয়ার জন্য। এ দিন গোটা প্রক্রিয়া নিয়েই প্রশ্ন তুললেন মমতা। সেই সূত্রে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে মানুষের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ আনলেন। তাঁর অভিযোগ, সুপ্রিম কোর্ট আধার কার্ডের মাধ্যমে ভর্তুকি বাধ্যতামূলক নয় বলে জানানোর পরও সেই ব্যবস্থা কার্যকর করছে কেন্দ্র।
প্রয়োজনে ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশনের (আইওসি) অফিস ঘেরাওয়ের হুমকিও দেন মমতা। তিনি বলেন, “দরকার হলে আইওসি-র অফিস ঘেরাও হবে। তবে এটা দলের সিদ্ধান্ত। দল আমাকে জানিয়েছে।”
ঘেরাওয়ের প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চায়নি আইওসি। সংস্থাটির এক কর্তা বলেন, “তেল মন্ত্রকের নির্দেশ মেনে শুধু আমরাই নই, হিন্দুস্থান পেট্রোলিয়াম ও ভারত পেট্রোলিয়ামও গোটা দেশে পর্যায়ক্রমে এই ব্যবস্থা চালু করেছে। তেল মন্ত্রক থেকে অন্য কোনও নির্দেশ আমরা পাইনি।” |
সাংবাদিক বৈঠকে। ছবি: সুদীপ আচার্য। |
এ দিন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কেন্দ্র আধার কার্ড বাধ্যতামূলক করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিল। সুপ্রিম কোর্ট তা খারিজ করে দিয়েছে। এখন শুনছি, কার্ড তৈরি করার জন্য কেন্দ্র মাত্র তিন মাস সময় দিয়েছে।” তাঁর অভিযোগ, তিন মাসে সব আধার কার্ড তৈরি সম্ভব নয়। “কার্ড না দিয়েই বলছে, আধার কার্ড না থাকলে গ্যাসের সিলিন্ডারে ভর্তুকি দেওয়া হবে না। আবারও বলছি, এটা কেন্দ্রের প্রকল্প। তাদেরকেই দায়িত্ব নিতে হবে।”
যদিও তেল সংস্থাগুলির দাবি, সুপ্রিম কোর্ট অন্তর্বর্তিকালীন নির্দেশ দিলেও এখনও চূড়ান্ত রায় দেয়নি। গত ২৯ সেপ্টেম্বর এ নিয়ে শুনানি হওয়ার কথা থাকলেও তা ফের পিছিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য গোটা ব্যবস্থাটিকেই মানুষের দুর্ভোগের সূত্র হিসেবে দেখছেন। দিল্লির প্রতি তাঁর প্রশ্ন, “গরিব মানুষ কত কার্ড করবে? এপিএল, বিপিএল, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড...! কার্ডের জন্যই তো এ বার ‘লকার’ রাখতে হবে। সব ধরনের কাজের জন্য একটিই কার্ড হওয়া উচিত। সেটা ‘ইউনিফর্ম কার্ড’ বা ‘ইউনিক কার্ড’ হতে পারে।”
তৃণমূল নেত্রীর আরও অভিযোগ, “আজ সকালেই আমাদের মুখ্যসচিব আধার কার্ড নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলেছেন। ওরা বলেছে, মাত্র ৬টি সিলিন্ডারে ভর্তুকি দেওয়া হবে। এতে গরিব মানুষের চলবে কী করে?” তেল সংস্থাগুলির অবশ্য দাবি, পরিবার পিছু একটি অর্থ বর্ষে ন’টি ভর্তুকির সিলিন্ডার মিলবে। ৬টি নয়।
সরকারি সূত্রে জানানো হয়েছে, ১১ নভেম্বর সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসবেন রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র। খাদ্য দফতরের অধিকর্তা রাজ্যের দফতরগুলির পাশাপাশি তেল মন্ত্রক, জাতীয় জনগণনা দফতর, আধার কর্তৃপক্ষ (ইউআইডিএআই) ও তেল সংস্থাগুলিকে ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বক্তব্য, লোকসভা ভোট যত এগিয়ে আসছে, ততই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কেন্দ্র-বিরোধী আওয়াজ জোরালো করছেন মমতা। আগে রাজ্যের জন্য আর্থিক প্যাকেজ চেয়ে দিল্লিতে ধর্না দেন তৃণমূল সাংসদরা। মেট্রোর ভাড়া বৃদ্ধির পরে কলকাতায় তার বিরুদ্ধে পদযাত্রা করেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়েও সরব হয়েছেন মমতা। বিমল গুরুঙ্গরা যখন পাহাড়ে টানা বন্ধ করছেন, তখনও তার পিছনে কেন্দ্রের উস্কানি দেখেছেন তিনি। এ বারে যোগ হল আধার কার্ডের ভিত্তিতে রান্নার গ্যাসের ভর্তুকির বিষয়টিও।
এর কারণ কী? তৃণমূলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, লোকসভা ভোটের আগে কেন্দ্রের নানা সিদ্ধান্তকে রাজ্য-বিরোধী বা জনবিরোধী বলে চিহ্নিত করতে চাইছেন মমতা। আধার-এর সঙ্গে শুক্রবার যেমন জুড়লেন পেট্রোল-ডিজেলের দাম বৃদ্ধির প্রসঙ্গও।
এ দিন দিল্লিতে এক প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম বলেন, “কেন আধার-এর মাধ্যমে ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সে কথা হলফনামা দিয়ে সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছি। এর ফলে ভুয়ো গ্রাহকদের চিহ্নিত করা সম্ভব। এর মধ্যেই প্রায় ৫০ হাজার ভুয়ো গ্রাহক চিহ্নিত করেওছি।” তিনি বলেন, “ভর্তুকি তো তুলে দিচ্ছি না। ভর্তুকিটা যাতে ঠিক লোক পায়, সে জন্য এই ব্যবস্থা।”
এ রাজ্যের সাধারণ গ্রাহক অবশ্য আধার নিয়ে এখনও আঁধারে। হাতে তিন মাস রয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে আধার কার্ড, নিদেনপক্ষে আধার নম্বর না পেলে বাজারদরেই গ্যাসের সিলিন্ডার কিনতে হবে রাজ্যের তিন জেলার গ্রাহকদের (কলকাতায় এখন যা ৯৮৪ টাকা)। আধার কর্তৃপক্ষের দাবি, এই ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে, সেখানে বেশির ভাগেরই আধার নম্বর তৈরি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু গ্রাহকদের অভিযোগ, কার্ড বা নম্বর পেয়েছেন নামমাত্র মানুষ। আরও অভিযোগ, আধার ওয়েবসাইটে গিয়েও সব সময় নম্বর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
আধার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ঢিমেতালে কাজের অভিযোগও উঠেছে। জাতীয় জনগণনা দফতর ও আধার কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, কাজ অনেকটাই হয়ে গিয়েছে। গোটা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে এ দিনই কলকাতায় বৈঠক করেন রেজিস্ট্রার জেনারেল অব ইন্ডিয়ার (যাদের অধীনে জনগণনা দফতর) ডিডিজি এস কে চক্রবর্তী, আধারের পূর্বাঞ্চলীয় কর্তা প্রদীপকুমার উপাধ্যায় ও জনগণনা দফতরের পূর্বাঞ্চলীয় কর্তারা। যে দুই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা আধার শিবিরের আয়োজন করে, সেই আইটিআইএল এবং ইসিআইএল-কে আরও দ্রুত শিবির করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। কার্ড দ্রুত বণ্টনের জন্য ডাক বিভাগের সিপিএমজি-কেও আর্জি জানান তাঁরা। |