আলুর দাম কমাতে তর্জন-গর্জনেই থেমে থাকল না সরকার। বেশি দামে আলু বিক্রি করার জন্য শুক্রবার সন্ধেয় শিলিগুড়ির দু’টি বাজারে হানা দিয়ে তিন জন খুচরো আলু ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করলেন টাস্ক ফোর্সের সদস্যরা। শেওড়াফুলিতে হাট থেকে এক জন খুচরো আলু ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
রাজ্য সরকার এই কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই শুক্রবার রাজ্যের আলু ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তিন দিন হিমঘর থেকে আলু না তোলার হুমকি দেন। রাজ্যের বাইরে আলু পাঠাতে না-দেওয়া ও দাম বেঁধে দেওয়ার প্রতিবাদে প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির এই সিদ্ধান্ত। এর উপরে চার জন গ্রেফতার হওয়ার ফলে রাজ্য সরকারের সঙ্গে সংঘাতের আবহই তৈরি হল বলে মনে করছেন আলু ব্যবসায়ীদের অনেকে। তিন দিন আলু না তোলার হুমকিতে বাজারে আলুর জোগানে টান পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাতে বাড়তে পারে দামও। তবে সরকারি নিষেধাজ্ঞায় ক্ষুব্ধ হলেও সরাসরি সংঘাতে যাওয়ার পক্ষপাতী নন আলু ব্যবসায়ীদের অন্য অংশ।
রাজ্যে এই মুহূর্তে আলুর যে কোনও অভাব নেই, তা মেনে নিচ্ছেন আলু ব্যবসায়ীরাই। ১৮ থেকে ২০ লক্ষ টন জমা রয়েছে হিমঘরগুলিতেই। নতুন আলুও উঠবে শীঘ্রই। তা হলে আলুর এই আকাশছোঁয়া দাম কেন? অভিযোগ, হিমঘর মালিক ও আলু ব্যবসায়ীদের একটা অংশ কৃত্রিম ভাবে পাইকারি দাম বাড়াচ্ছেন। যার ফলে দাম বাড়ছে খুচরো বাজারেও। এই ব্যবসায়ীরা এখন শাসক দলের ছত্রছায়ায় রয়েছেন বলে বিরোধীরা অভিযোগ তুললেও সরকারের দাবি, আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাজনীতির রং দেখা হবে না। কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে দোষী সকলের বিরুদ্ধেই। যার জের চার ব্যবসায়ীর গ্রেফতার।
শিলিগুড়ির মহকুমাশাসক দীপাপ প্রিয়া এ দিন দুপুরেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা নিয়ে। সেই বৈঠকে ব্যবসায়ীরা বেশি দামে আলু কিনেছেন বলে মহকুমাশাসককে জানান। তবে তা তিনি মানেননি। দীপাপ প্রিয়া পরে বলেন, “ব্যবসায়ীরা সকলেই সরকারি নির্দেশ মানতে রাজি হয়েছেন। নির্দেশ অমান্য করলে গ্রেফতার করা হবে।” কিন্তু তেমন ব্যবস্থা যে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নেওয়া হবে, তা অবশ্য ভাবতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। এ দিন সন্ধেয় চম্পাসারি বাজার থেকে দু’জন এবং ক্ষুদিরামপল্লি বাজার থেকে এক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়। মহকুমাশাসক দীপাপ প্রিয়া বলেন, “সরকারি নির্দেশ অমান্য করার অপরাধে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে। ওঁরা ১৩ টাকার বেশি দামে আলু বিক্রি করছিলেন। এই অভিযান আপাতত লাগাতার চলবে।”
রাতে শিলিগুড়ি বিধান মার্কেট খুচরো ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক সুবল সাহা বলেন, “ওই ব্যবসায়ীদের আর একটা সুযোগ পাওয়া উচিত ছিল।” গ্রেফতার নিয়ে রাত পর্যন্ত অবশ্য কোনও খবর পাননি রাজ্যের কৃষি-বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায় এবং মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার। বরং শিলিগুড়ির খবর জানার পরে প্রদীপবাবু বলেন, “ব্যবসায়ীদের কেন গ্রেফতার করা হবে, তা বুঝতে পারছি না।”
দাম কমাতে সরকার কঠোর হলেও প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক রামপদ পাল এ দিন বলেন, “সরকার অন্যায় করছে। অন্য রাজ্যে আলু যেতে না-দিয়ে ও ছোট ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করে ভুল করছে।” এর প্রতিবাদে আজ, শনিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত হিমঘর থেকে আলু তোলা বন্ধ রাখবেন তাঁরা।
বেশি দামে আলু বিক্রির জন্য কোনও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের হলে ধর্মঘটে নামার হুমকি দিয়েছে রায়গঞ্জের মোহনবাটি বাজারের ব্যবসায়ীরাও। তাঁরা বলেন, “পাইকারি দর না বেঁধে দিলে কম দামে আলু বিক্রি করা সম্ভব নয়।” মালদহের ব্যবসায়ীরা দাম কমানোর জন্য দু’-তিন দিন সময় চেয়েছেন। জেলার মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী বলেন, “গরিব ব্যবসায়ীদের জোর করতে চাই না। দু’দিন সময় দেওয়া হয়েছে।”
পাইকারি দর নিয়ে একই কথা বলছেন কলকাতার নিউ মার্কেটের দোকানিরাও। এ দিনই অভিযানের সময় শামিম আহমেদ নামে এক জন দোকানিকে বেশি দামে আলু বিক্রি করার জন্য সতর্ক করেন পুরসভার বাজার দফতর ও কলকাতা পুলিশের এনফোর্সমেন্ট শাখার অফিসাররা। তাঁরা চলে যাওয়ার পরেই শামিম বলেন, “বেশি দামে মাল কিনেছি। অফিসাররা বললেই কি কম দামে বেচতে হবে? আপনারা কিনতে হলে কিনুন, না হলে চলে যান।”
এনফোর্সমেন্ট শাখা সূত্রের খবর, এ দিন সরকারি অফিসারদের ৬টি দল কলকাতার বিভিন্ন বাজারে অভিযান চালিয়েছে। ডিসি (এনফোর্সমেন্ট) রবীন্দ্রনাথ সরকারের দাবি, “যে সব বাজারে অভিযান হয়েছে, সেখানে ১৩ টাকা দরেই আলু বিক্রি হয়েছে।” কিন্তু মানিকতলা, সল্টলেক, গড়িয়াহাট, বেহালা, হাতিবাগানের ক্রেতারা জানিয়েছেন, এই সব বাজারে ১৫-১৬ টাকা দরেই আলু বিক্রি হয়েছে। এনফোর্সমেন্ট শাখার অফিসাররাই মানছেন তাঁরা বাজার ছেড়ে বেরোনো মাত্রই ফের তা ১৫-১৬ টাকা হয়ে গিয়েছে। এক অফিসারের বক্তব্য, “ক্রেতাদের সজাগ থাকতে হবে। দাম বেশি চাইলে প্রতিবাদ করতে হবে।”
বেশি দামে আলু বিক্রি হয়েছে রামপুরহাট, দুর্গাপুর, কালনা, তমলুক, খড়্গপুরেও। তমলুক বড়বাজারের ব্যবসায়ী শচীন্দ্রনাথ হাজরা বলেন, “আমরাই ১৪ টাকা দরে আলু কিনেছি। কম দামে বিক্রি করব কী করে!” হাওড়ায় খোদ কৃষি-বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায়ের বাড়ির অদূরে কালীবাবুর বাজারেই মুখ্যমন্ত্রীর বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে কেজি প্রতি ২ টাকা বেশি দরে জ্যোতি আলু বিক্রি হয়েছে।
আজ, শনিবার কালীপুজোর দিন থেকেই কলকাতার সখেরবাজার, লেক মার্কেট, শ্যামবাজার, রাজাবাজার, নাগেরবাজার, সল্টলেকের করুণাময়ী এবং কালীঘাট বাজার থেকে ১৩ টাকা কেজি দরে জ্যোতি আলু বিক্রি করবে রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার বলেন, “শুধু কলকাতা নয়, আলিপুরদুয়ার, ধুপগুড়ি এবং জলপাইগুড়িতেও সরকারি দরে আলু বিক্রি করা হবে।” প্রশ্ন উঠেছে, মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণার পরেও দাম কমলো না কেন? অরূপবাবুর বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা বাজারে যেতে সময় লাগবে। দু’-এক দিনে জ্যোতি আলুর দাম কমবে। চন্দ্রমুখী নিয়ে ভাবছি না। সব সময়ই তার দাম বেশি থাকে।” |