টিভি-র পর্দা থেকে গরিবের ভিটে। ভায়া রেশন দোকান।
নামী ব্র্যান্ডের নানা সামগ্রী শহরের ঝাঁ-চকচকে শপিং মলে সাজানো থাকে থরে থরে। তার বেশির ভাগই গাঁ-গেরামের গরিব-গুর্বোদের অধরা থেকে যায়। টিভি-র বিজ্ঞাপনে দেখে আশ মেটাতে হয় তাঁদের। তা সে খাবারদাবারই হোক কিংবা প্রসাধনী। এ বার রেশন দোকানের মাধ্যমে তা সহজলভ্য হয়ে উঠবে গ্রামীণ মানুষের কাছেও। সেখানেই মিলবে নামী ব্র্যান্ডের তেল-সাবান-শ্যাম্পু থেকে শুরু করে প্যাকেটবন্দি খাদ্যসামগ্রী।
কিন্তু মিললেই তো হল না। ওই সব জিনিসপত্র কেনার সঙ্গতিও তো দরকার! তার কী হবে?
রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক জানান, গ্রামের সাধারণ মানুষ নামী ব্র্যান্ডের সামগ্রী যাতে সাধ্যের মধ্যে পান, তার জন্য দু’রকম ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
• ক্রেতারা ওই সব পণ্য পাবেন বাজারদরের থেকে সাত শতাংশ কম দামে।
• ওই শ্রেণির ক্রেতাদের কথা ভেবেই নামী সংস্থাগুলি তাদের পণ্য সরবরাহ করবে ছোট ছোট প্যাকেট বা পাউচে। এতে গ্রামীণ মানুষের চাহিদা মেটানো যাবে, রেশন দোকানগুলিও লাভবান হবে। কারণ, ওই সব পণ্য বিক্রি করলে তারা কমিশন পাবে এক শতাংশ হারে। প্রতিটি পাউচ বা প্যাকেটে ‘পিডিএস’ (পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম) কথাটি লেখা থাকবে, যাতে ওই সব পণ্য খোলা বাজারে বিক্রি হতে না-পারে।
রেশনে বিভিন্ন নামী সংস্থার জিনিসপত্র মিলবে কবে?
খাদ্যমন্ত্রী জানান, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই গোটা রাজ্যে এই বিপণন ব্যবস্থা চালু হয়ে যাবে। ওই সব পণ্য মজুত করতে রেশন দোকানের মালিককে কোনও খরচ করতে হবে না। সংস্থাগুলি নিজেদের খরচেই পণ্য পৌঁছে দেবে রেশন দোকানে। জ্যোতিপ্রিয়বাবু বলেন, “ইতিমধ্যেই গ্ল্যাক্সো (হরলিকস প্রস্তুতকারক সংস্থা), হিন্দুস্থান লিভার, বিঙ্গো চিপস, টাটা লবণ, ব্রিটানিয়া, বিস্ক ফার্ম, ফরচুন তেল সংস্থার সঙ্গে খাদ্য দফতরের চুক্তি হয়েছে। আগে থেকেই চুক্তি আছে মশলা প্রস্তুতকারক কুকমি এবং সানরাইজ-এর সঙ্গে।” আটা প্রস্তুতকারক নামী সংস্থার সঙ্গেও কথা চলছে রাজ্যের।
সরকার হঠাৎ রেশনে ওই সব জিনিস বিক্রির ব্যবস্থা করছে কেন?
খাদ্য দফতরের এক কর্তার ব্যাখ্যা, খাদ্য নিরাপত্তা আইন বলবৎ হয়ে গেলে রেশন দোকানের গুরুত্ব কমে যেতে পারে। কারণ, গ্রাহকেরা সরকারি ভর্তুকির টাকা সরাসরি নিজেদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পেয়ে যাবেন। সে-ক্ষেত্রে তাঁরা রেশন থেকে খাদ্যসামগ্রী না-নিয়ে সরাসরি বাজার থেকেও কিনতে পারেন। এই অবস্থায় রেশনে যদি একটু সস্তায় নামী সংস্থার পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করা যায়, কার্ডধারীরা সেখানে যাবেন বলেই আশা করা হচ্ছে। রাজ্যে ২০ হাজারেরও বেশি রেশন দোকানের সঙ্গে প্রায় তিন লক্ষ মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িয়ে আছে। একটু ভিন্ন রূপে রেশন দোকান চালু রাখতে পারলে তাঁরাও সমস্যায় পড়বেন না।
সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন অল বেঙ্গল রেশন শপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বম্ভর বসু। তবে তিনি মনে করেন, কার্ডধারীদের রেশন দোকান থেকে জিনিস কিনতে বাধ্য করাতে না-পারলে এই ব্যবস্থা সফল হবে না। তিনি বলেন, “খাদ্য সুরক্ষা আইন অনুযায়ী রেশন বাবদ গ্রাহকের ভর্তুকির টাকা সরাসরি ব্যাঙ্কে চলে যাবে। সেই টাকায় তিনি যে রেশন দোকান থেকেই জিনিস কিনবেন, তার নিশ্চয়তা কোথায়? সরকার রেশনে যে-সামগ্রী সাত শতাংশ কম দামে দেবে, পাড়ার অন্য দোকান সেটা দেবে হয়তো ১০ শতাংশ কম দামে। সে-ক্ষেত্রে কার্ডধারীরা রেশন দোকানে যাওয়ার উৎসাহ পাবেন না।”
শুধু তা-ই নয়। বিশ্বম্ভরবাবুদের বক্তব্য, খাদ্য সুরক্ষা আইন কার্যকর হলে এমনিতেই শহরের ৫০ শতাংশ এবং গ্রামের ২৫ শতাংশ মানুষ রেশন ব্যবস্থার বাইরে চলে যাবেন। বর্তমান নিয়মে রেশন কার্ড চালু রাখতে গেলে মাসে অন্তত এক বার রেশন দোকান থেকে কোনও না কোনও সামগ্রী কিনতে হয়। কিন্তু আগামী দিনে তা এক মাসের জায়গায় দু’মাস করা হবে। ফলে রেশন দোকানে বিক্রির হাল মোটেই ভাল হবে না। এখনও রেশন দোকানে কুকমি, সানরাইজ মশলা, লবণ, কাগজ-পেনসিল, ডিটারজেন্ট বিক্রির ব্যবস্থা আছে। বিশ্বম্ভরবাবু জানান, কার্ড বাঁচানোর জন্য কেউ কেউ এর মধ্যে কিছু কিছু জিনিস কেনেন ঠিকই। তবে বেশির ভাগই এতে আগ্রহী নন। শুধু নামী ব্র্যান্ডের পণ্য রাখলেই গ্রাহক রেশন দোকান থেকে তা কিনতে উৎসাহী হবেন, এমন আশা করা যায় না।
খাদ্যমন্ত্রী এই বক্তব্য মানেননি। তিনি বলেন, “এখন রেশন দোকানে কিছু অনামী কোম্পানির জিনিস বিক্রি হয়। মানুষ সেই সব সংস্থার নামই শোনেননি। তাই তাদের পণ্য বিক্রি হয় না। গ্রামবাসী ব্র্যান্ডেড জিনিস চান। সেটাই দিতে চাইছি রেশনে।” |