কাইতাকুড়া। ৩৩ কোটি দেবতার মধ্যে সম্ভবত ইনি একজন। ময়নাগুড়ির জনবহুল এলাকা থেকে শ্মশান পথে যেতে বাঁ দিকে গোবিন্দনগর এলাকা। এখানেই রয়েছে কাইতাকুড়ার মন্দির। মন্দিরের পাশে বইছে ক্ষীণস্রোতা জরদা নদী। নদীর এক ধার ঘেঁষে দূর পর্যন্ত ঘন বাঁশবন। অন্য পারে ইতস্তত জনবসতি। দূরে শ্মশানের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠে। দিনদুপুরেই আবছায়া অন্ধকার। মন্দির সংলগ্ন সরু সংকীর্ণ চিলতে পথ নেমে গেছে ঘাটের দিকে। স্থানীয়দের কাছে এই ঘাট কাতাইকুড়ার ঘাট নামেই পরিচিত। এই নদী ও নদীর ঘাট ঘিরেই যাবতীয় কৌতূহল, কথা ও কাহিনি। প্রবীণ বাসিন্দা চুনীলাল সোম জানান, প্রতি বছর এই ঘাট সংলগ্ন নদী গর্ভে পশু এমনকী মানুষ তলিয়ে যায়। |
মূলত রাজবংশীদের উপাস্য দেবতা কাইতাকুড়া। তবে সেই অদৃশ্য শক্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে শুধু রাজবংশী মানুষ নয়, এলাকার সবাই কাইতকুড়ার পূজা করে থাকেন। জনশ্রুতি রয়েছে, নদীর গর্ভে আছে এক রাজপ্রাসাদ। রাজা প্রতি বছর কোনও এক জনকে তাঁর কাছে টেনে নিয়ে যান। প্রচলিত কাহিনিটা এই রকম : স্থানীয় জোতদার তিলক রায়ের কন্যা তিতেশ্বরী রায়ের একমাত্র ছেলে ছেরু রায় বর্ষায় জরদা নদীতে ভেসে যায়। ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আশায় ছেরুর মা কাইতাকুড়ার কাছে মানত করেন। পরে এক কিমি দূর থেকে ছেরু উদ্ধার হয়। কিন্তু মা মানতের কথা ভুলে গেলে ছেরু গভীর অসুখে আক্রান্ত হয়। তিতেশ্বরী ছুটে যায় পুরোহিত পর্বদেব রায়ের কাছে। পুরোহিতের পরামর্শে কাতাইকুড়া-র পুজো করলে ছেলে সুস্থ হয়ে ওঠে। |
রাজবংশী ভাষায় কাইতা শব্দের অর্থ কাত হওয়া বা হেলে পড়া। কুড়া অর্থে গভীর গর্ত। ভাবার্থ করলে দাঁড়ায় আচরণে শিথিলতা ঘটে গেলে পতন অনিবার্য। টিনের চালার মন্দিরে রয়েছে পৃথক দুটি ঘর। এক ঘরে গাধার পিঠে আসীন পুরুষরূপী কাইতাকুড়া। পাশে উর্দিপরা লাঠিয়াল। অন্য ঘরে পূজিত হন রাজা ও রানি। চারটি মূর্তিই মাটির। ইতিহাসবিদ আনন্দগোপাল ঘোষ জানান, অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে তিব্বত ও ভুটানের সঙ্গে বঙ্গদেশের সমতলের যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল এই ময়নাগুড়ি। ময়নাগুড়ি ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে যে সব দেবদেবী বা পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন মেলে তাতে তিব্বতের ইতিহাস ঐতিহ্য, সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষণীয়। এই সব লৌকিক দেবদেবীর মধ্যেও তান্ত্রিক প্রভাব ও ভুটানের বৌদ্ধিক প্রভাব লক্ষ করা যায়। উপেন্দ্রনাথ বর্মনের স্মৃতি কথায়, ‘ভোটান যাওয়া’য় এর উল্লেখ আছে। অর্থ ফিরে না আসা। ভুটানি সৈন্যরা কাউকে ধরে নিয়ে গেলে সে ফিরে আসত না। এর প্রতিকারের জন্য স্থানীয় জোতদার সম্ভবত এই পুজোর প্রচলন করেন। ফি বছর কালীপুজোর ঠিক পর দিন এই দেবতার পুজো হয়। মন্দিরে প্রায় ৪ শতাধিক লোক সমাগম হয়। |
পুজোর আচার এ রকম : বাইশটি করে ধূপকাঠি চারটি মূর্তির উদ্দেশে জ্বালানো হয়। একটি মাটির মালসাতে থাকে জল, দুধ, আতপ চাল, ফুল ও তিল। ধূপকাঠির গোড়ায় সেই মালসার জল অঞ্জলি ভরে দেওয়া হয়। পুজোর মন্ত্র : ‘কাতাইকুড়া নমস্তে আকবর হরি হরি বল।’ শুকনো চিঁড়ে, আখের গুড় এবং আটিয়া কলা নিবেদন করা হয়। পুজোর সময় হল ভরদুপুর। চার ঘণ্টা লাগে পুজো সম্পন্ন হতে। নিত্যপুজো হয় না। মন্দিরের পুরোহিত অলক্ষ্য রায় বলেন, আগে বলি ছিল না। এখন অনেকে পায়রা বলি। জোতদার তিলক রায়ের দান-করা ৪ ডেসিমেল জমিতে গড়ে ওঠে মন্দির। লোকসংস্কৃতি গবেষক দীনেশ রায় জানান, এই অঞ্চলে এমন বহু উদাহরণ রয়েছে যেখানে জনৈক ব্যাক্তি পরে দেবায়িত হন। যেমন ভোটঠাকুর, বুড়াবুড়ি থান, থুকশিয়া থান, ভান্ডা কুড়া। ব্যক্তি পূজার প্রচলন ময়নাগুড়িতে ছিল। এমন হতে পারে এ অঞ্চলে কাইতা নামে কারওকে কেন্দ্র করে এর সূত্রপাত। |