|
|
|
|
জঙ্গলমহলে রাস্তা বানাবে কেন্দ্রীয় সংস্থা
প্রভাত ঘোষ • কলকাতা |
তোলাবাজির দাপটে বেসরকারি ঠিকাদারেরা পিছিয়ে গিয়েছে। বরাত নেওয়ার লোক মিলছে না।
অগত্যা পশ্চিমবঙ্গে জঙ্গলমহলের তিন জেলায় (পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-পশ্চিম মেদিনীপুর) পাকা সড়ক নির্মাণের দায়িত্ব দুই কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতে তুলে দিতে চলেছে রাজ্য পঞ্চায়েত দফতর। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের বিশেষ তালিকাভুক্ত (ইন্টিগ্রেটেড অ্যাকশন প্ল্যান) হওয়ার সুবাদে এই তিন জেলার উন্নয়নে সড়ক যোজনার টাকা ছাড়াও বিশেষ আর্থিক সাহায্য মেলে। অথচ রাজ্যের বাকি ১৪ জেলায় গ্রামীণ সড়ক নির্মাণের কাজ সন্তোষজনক হলেও এখানে তার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি বলে পঞ্চায়েত দফতর নিজেই মেনে নিয়েছে।
আর এর অন্যতম কারণ হিসেবে নানা সময়ে নানা মহল থেকে আঙুল উঠেছে জঙ্গলমহলে তোলাবাজির রমরমার দিকে। যার মোকাবিলায় এ বার কেন্দ্রীয় নির্মাণসংস্থাকে দায়িত্বদানের সিদ্ধান্ত। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, যে বাধার মুখে পড়ে রাজ্যের বেসরকারি ঠিকাদার সংস্থারা পিছিয়ে গেল, কেন্দ্রীয় সংস্থাকেও কি তার মুখে পড়তে হবে না? যা শুনে রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের আশ্বাস, “এমন হলে কেন্দ্রীয় সংস্থাকে সব রকম সাহায্য করবে রাজ্য। প্রয়োজনে পুলিশি নিরাপত্তা দিয়ে কাজ করানো হবে।”
অতএব, আর সমস্যা হবে না বলে আশা প্রকাশ করেছেন সুব্রতবাবু। কিন্তু প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে তো রাজ্যের ঠিকাদারদের দিয়েই কাজ করানো যেত? তা হল না কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়েছেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী। সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, আগে জঙ্গলমহলে কাজ করতে গেলে ঠিকাদারেরা মাওবাদীদের মোটা ‘লেভি’ দিতে বাধ্য হতেন। ইদানীং মাওবাদী দৌরাত্ম্যে লাগাম পড়েছে, কিন্তু তাদের জায়গা নিয়েছে স্থানীয় তোলাবাজেরা। এবং অভিযোগের তির মূলত শাসকদলের দিকে। প্রশাসন-সূত্রের দাবি: বিভিন্ন সময়ে সরকারি কর্তাদের কাছে বিভিন্ন ঠিকাদার অভিযোগ জানিয়ে বলেছেন, স্থানীয় নেতৃত্বের সব স্তরকে খুশি না-রাখলে কাজ চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে। এ হেন চাপের মুখে পড়েই অধিকাংশ ঠিকাদার সংস্থা জঙ্গলমহলে সড়ক নির্মাণের বরাত নিতে চাড় দেখায়নি বলে প্রশাসনের অন্দরের খবর।
যার পরিণতিতে জঙ্গলমহলে পথ নির্মাণের অগ্রগতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কেন্দ্র। সমস্যা সমাধানে তারাই প্রস্তাব দেয়, প্রকল্পগুলো রূপায়ণের ভার কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতে ছাড়া হোক। পঞ্চায়েত-সূত্রের খবর: গত ৮ নভেম্বর দিল্লিতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে এক বৈঠকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে। “জঙ্গলমহলে রাস্তা তৈরির জন্য তিন বার টেন্ডার ডাকা হলেও কোনও ঠিকাদার সংস্থা বরাত নিতে আগ্রহ দেখায়নি। এই পরিস্থিতিতে দিল্লির প্রস্তাব মেনেই ন্যাশনাল বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন (এনবিসিসি) এবং ন্যাশনাল প্রজেক্টস কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন (এনপিসিসি)-কে কাজের বরাত দেওয়া হচ্ছে।” বলেছেন রাজ্যের পঞ্চায়েত-সচিব সৌরভ দাস।
কেন্দ্রীয় সংস্থা দু’টি কী ভাবে তোলাবাজি সামাল দেবে?
এনবিসিসি-র আঞ্চলিক প্রধান নির্মলকুমার সিংহের মন্তব্য, “ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা বা ত্রিপুরায় আমাদের একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। এমন উৎপাত মোকাবিলার কৌশল আমরা জানি।” এনপিসিসি-র আঞ্চলিক ম্যানেজার অমিতাভ দত্তের কথায়, “তোলাবাজির সমস্যা সারা দেশেই। আমরা ঠিক করেছি, দেশের বড় বড় ঠিকাদার সংস্থাগুলোকে এখানে কাজে লাগাব। কারণ এ সব বাধা কাটিয়ে কী ভাবে কাজ চালাতে হয়, তার অভিজ্ঞতা ওদের বিলক্ষণ আছে।”
রাজ্যের নির্মাণ-ঠিকাদার মহলের একাংশের বক্তব্য, অধিকাংশ জায়গাতেই তোলা দিতে হয়। কোথাও কম, কোথাও বেশি। কিন্তু জঙ্গলমহলে তোলার বিপুল অঙ্কের সঙ্গে উপরি জুটছে কাজ বন্ধের হুমকি। কাজ থমকে গেলে যা লোকসান হয়, স্থানীয় ঠিকাদারদের পক্ষে তা বরদাস্ত করা কঠিন। উপরন্তু জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা না-পাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় সংস্থার ব্যানারে কাজ হলে প্রশাসন কড়া মনোভাব দেখাতে পারে। তাতে তোলাবাজদের দাপাদাপি কমলেও কমতে পারে বলে আশা করছেন নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত অনেকে। ওঁদের কথায়, “বড় বড় ঠিকাদার সংস্থা এলে ছবিটা পাল্টানোর যথেষ্ট সম্ভাবনা।”
রাজ্যে রাজ্যে গ্রাম-গঞ্জ জুড়ে রাস্তা নির্মাণ খাতে ‘প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা’ প্রকল্পের আওতায় অর্থ বরাদ্দ করে কেন্দ্রীয় সরকার। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দাবি, এ রাজ্যে এই প্রকল্পে বাম আমলের তুলনায় এখন কাজ হচ্ছে অনেক ভাল। সরকারি তথ্যানুযায়ী, পূর্বতন বামফ্রন্ট জমানার শেষ বারো বছরে ৩২৩ কোটি টাকা খরচ করে রাজ্যে ১৭৩টি রাস্তা হয়েছে, যার সম্মিলিত দৈর্ঘ ৯৮৭ কিলোমিটার। আর নতুন সরকারের প্রথম দু’বছরেই ৪১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে হয়েছে ২৭৩টি রাস্তা। মোট ১২৮১ কিলোমিটার।
এ হেন সাফল্যের মধ্যেই ব্যতিক্রম হয়ে রয়েছে জঙ্গলমহলের তিন জেলা। কেন্দ্রীয় সংস্থা কবে ওখানে কাজে নামবে?
পঞ্চায়েতমন্ত্রী বলেন, “গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক চুক্তির শর্তাবলি তৈরি করছে। নভেম্বরের গোড়ায় সংস্থা দু’টির সঙ্গে রাজ্যের চুক্তি হবে।”
তাদের হাত ধরে জঙ্গলমহলও এ বার সড়ক উন্নয়নের যজ্ঞে সামিল হতে পারে কিনা, সেটাই দেখার। |
|
|
|
|
|