সেকালের ডাকাতদের পূজ্য কালীই এখন সর্বজনীন
সেকালের নবদ্বীপের এক ক্রোশ পশ্চিমের গ্রাম ব্রহ্মাণীতলা। গ্রাম বলতে যা বোঝায় তার থেকে ব্রহ্মাণীতলা অনেকটাই আলাদা। জনবসতি অত্যন্ত কম। চারপাশে ধূ ধূ প্রান্তর। তার মাঝখানে এক গাছতলায় কালীমূর্তি। সিদ্ধেশ্বরী কালী নামে খ্যাত এই দেবীমূর্তি কে বা কারা কবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা কেউ জানেন না। এক বার রটন্তী কালীপুজোর রাতে এই দেবীমূর্তির সামনে এক গোপন পূজা হয়েছিল। কারা ছিলেন এই পুজোর আয়োজক, তা জানা যায়নি।
রটন্তী কালীপুজোর পরদিন সকালে সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরে নিত্যপুজো করতে গিয়ে পুরোহিত দেখেন মন্দিরের চাতালে থরে থরে সাজানো মায়ের পুজোর ষোড়শোপচার। তার সঙ্গে চারখানা পট্টবস্ত্র-উত্তরীয়, ঘট সমেত তৈজসপত্র, প্রচুর নৈবেদ্য। আর আটটা পিতলের বাটিতে রক্ত। আশপাশে কোনও ছাগ বা মহিষমুণ্ড পড়ে নেই। অভিজ্ঞ ব্রাহ্মণ বুঝতে পারেন এ নররক্ত। আসলে ব্রহ্মাণীতলার দূরবর্তী নানা অঞ্চলে বহু ডাকাতের বসবাস ছিল। পরে ওই ব্রাহ্মণ অনুসন্ধান করে জেনেছিলেন তার অনুমান অভ্রান্ত। রটন্তী কালীপুজোর রাতে সে বার নরবলি দিয়েছিল ডাকাতরা। তবে নৈবেদ্যর থালার পাশে পাঁচটি টাকা দক্ষিণা রেখে একটি চিরকুটে ব্রাহ্মণকে যথাবিহিত পুজো করার অনুরোধ জানিয়ে যায় তারা। ১৮১৯ সালের সমাচার দর্পণের ২৭ নভেম্বর সংখ্যায় সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘গুপ্তপূজা’ শিরোনামে।
দক্ষিণাকালী মূর্তির স্রষ্টা আগমবাগীশের জন্মভূমি নবদ্বীপের কালীপুজোকে ঘিরে ডাকাতদের এ-হেন আচরণ অস্বাভাবিক নয়। আবার নবদ্বীপের গঙ্গার পূর্বপাড়ে চৈতন্যদেবের মাতুলালয় বেলপুকুর বা বিল্বপুষ্করিণী গ্রামে কালীপুজোর রাতে তিনশোর বেশি পুজো হয়। অন্য দিকে নদিয়ার শান্তিপুর হল অদ্বৈতাচার্যের শ্রীপাঠ। সেখানে কালীপুজোর ইতিহাস কয়েক শতাব্দীর। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের প্রপৌত্র রত্নগর্ভ সার্বভৌমের প্রচলিত পুজো এখানে সবচেয়ে প্রাচীন। শুধু তাই নয়, ‘ডাকাতে কালী’র সংখ্যা এখানে হাতে গুনে শেষ করা যায় না।
১৯৪৬-এর দাঙ্গা। সাম্প্রদায়িকতার আগুনে গোটা বাংলার সঙ্গে জ্বলছে শান্তিপুরের মানুষ। সেই সময়ে শান্তিপুরের কালী মুখার্জির মাঠে একদল স্থানীয় যুবক শুরু করেন কালীপুজো। বিনু পাঠক, সুনীল পাল, জগা পাল প্রমুখের হাতে এই পুজোর শুরু। নাম ছিল ‘বোম্বেটে কালী’। পরে এটি বামাকালী নামে পরিচিত হয়। কিন্তু কেন এমন নামকরণ?
শান্তিপুরের বিধায়ক তথা পুরপ্রধান অজয় দে বলেন, “ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে শক্তি, সাহস এবং সাফল্য প্রার্থনা করে কালীপুজো করত। প্রাক্-স্বাধীনতা যুগে ভবানী পাঠক, রঘু ডাকাত বা বিশে ডাকাতের ভাবমূর্তি ছিল অত্যন্ত ভাল। এদের পরোপকারী রবিন হুড ইমেজের জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে এদের প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা ছিল। তাই এরা যখন চলে গেল, স্থানীয় মানুষজন ওদের পরিত্যক্ত কালীমন্দিরগুলিতে সাড়ম্বরে পুজোপাঠ শুরু করে দিলেন। আর সঙ্গে একটা অতীত ইতিহাস থাকাতে এ সব পুজো ‘ডাকাতে কালী’রা বিখ্যাত হয়ে উঠলেন।”
কালী মুখার্জির মাঠের বোম্বেটে কালী, কাশ্যপপাড়ার ডাকাতে কালী, চরজিজিবার ডাকাতে কালী, কাঁসারিপাড়া, বুড়োশিবতলার ডাকাতে কালী ইত্যাদি। স্থানীয় ইতিহাসের গবেষকরা মনে করেন, এই সব কালীর প্রতিটিই কোনও না কোনও ডাকাতদলের প্রতিষ্ঠা করা। স্থানীয় স্কুলশিক্ষক অকৈতববাবু বলেন, “সেকালে জমিদার আর ডাকাতরা বেশি করে কালীপুজো করতেন। আবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবীরাও কালীর উপাসনা করতেন। ইংরেজপন্থী জমিদার বা ভূস্বামীদের তহবিল লুঠ করার আগে ওই বিপ্লবীরা কালীপুজো করতেন। আবার কার্যসিদ্ধি হলে সাড়ম্বরে কালীপুজো করতেন তারা। সব মিলিয়ে প্রাক্-স্বাধীনতা যুগে কালীপুজো এবং ডাকাত, দুই সমার্থক হয়ে গিয়েছিল।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.