মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, রাজ্যের অনুমতি না নিয়ে তিস্তা-ব্যারেজ থেকে বাংলাদেশকে জল ছাড়া হয়েছে। কথাটা ঠিক বোঝা গেল না। আনন্দবাজার পত্রিকায় (কলকাতা সংস্করণ, ২৪-১০, ৬-এর পাতা) দু’টি বিস্তারিত রিপোর্টে এই খবরের কার্যকারণ বোঝা গেল, ‘তিস্তা চুক্তি নিয়ে ফের চেষ্টা...’ ও ‘বাংলাদেশকে বাড়তি জল কেন...’। কিন্তু তাতে দুর্বোধ্যতা বরং বাড়ল। খবরটিতে জানা গেল, ২২ অক্টোবর ‘প্রশাসনিক বৈঠকে’ই ‘সুখা মরসুমে’ ‘বাংলাদেশকে কেন বেশি পরিমাণ জল ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে সেচকর্তাদের জবাবদিহি চান মমতা।’ তা হলে তো এটা ২০১২-র নভেম্বর থেকে ২০১৩-র মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত এই ছ’মাস হতে হয়। অথবা, তার আগের বছরেরও এই ছ’মাসই হতে হয়।
এখানে একটা কথা পরিষ্কার করা ভাল। পশ্চিমবঙ্গের গড় সুখা মরসুম ও বর্ষা মরসুমের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের উত্তরাংশের সুখা ও বর্ষা মরসুমের মিল নেই। দার্জিলিং-জলপাইগুড়ি-কোচবিহার-উত্তর দিনাজপুরে মে থেকে অক্টোবর, এই ছ’মাসই বর্ষাকাল। মধ্য, দক্ষিণ ও পশ্চিম পশ্চিমবঙ্গে তা নয়। উত্তর অঞ্চলে বারোটা মাসকেই সমান ভাগে ভাগ করে দেওয়া যায় মধ্য বৈশাখ থেকে কার্তিকের গোড়া বর্ষাকাল আর অক্টোবর থেকে মে অ-বর্ষাকাল। বার্ষিক বৃষ্টির মাসিক হিসেবে এই ভাগটা বহুকাল প্রমাণিত। কার্তিক মাসেই জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারের কোনও কোনও জায়গায় আগুরিপাক কাতার ধান কাটা হয়। উত্তরবঙ্গের এই উত্তরে বোরো চাষ প্রধান চাষ নয়। আজকাল বীজ ও সারের উন্নতির ফলে কোনও কোনও উঁচু জায়গায় বোরো চাষ হচ্ছে বটে, কিন্তু তার ভিত্তিতে এই অভিযোগ কোনও ভাবেই দাঁড় করানো যাবে না যে, সুখা মরসুমে, মানে শীতকালে, তিস্তার জল তিস্তা-ক্যানালে না ঢেলে বাংলাদেশকে দেওয়া হচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত করতেই হয় যে, মুখ্যমন্ত্রীকে ভুল বোঝানো হয়েছে। এবং এটাও মনে করার কারণ আছে যে, এই ভুল বোঝানোর পিছনে মতলবও আছে। |
তিস্তা-ব্যারেজের জল বাংলাদেশকে কোন ঋতুতে কতটা ছাড়া হবে, এই নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর (ও সরকারের) সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের যুক্তিসংগত মতপার্থক্য আছে। কিন্তু তাঁর পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি থাকা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করে তাঁর কথা বলছেন না। সেই অস্পষ্টতার সুযোগ নিচ্ছে তিস্তা-ব্যারেজের সঙ্গে যাঁদের স্বার্থ জড়িয়ে আছে, তেমন একটি অসংগঠিত অথচ নিশ্চিত দল। সেই দলের মধ্যে থাকতে পারেন কন্ট্রাক্টর (ছোট ও বড়), ইঞ্জিনিয়ার, তিস্তা-ক্যানালের সংলগ্ন কিছু আশাবাদী জমির মালিক, ফুলবাড়ি এলাকারও কিছু জমির মালিক। এই দলের স্বার্থ অনুযায়ীই এই এমন একটা কথা রটানো হচ্ছে যে, তিস্তার প্রধান খাত দিয়ে তিস্তাকে বইতে দেওয়ার অর্থ বাংলাদেশকে জল দেওয়া ও উত্তরবঙ্গের (আসলে শুধুই জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার একটি অংশের) কৃষির জন্য দরকারি সেচ না-দেওয়া। এটা কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। আর, তিস্তা-ব্যারাজ থেকে তিস্তার প্রধান খাতে জল না দিয়ে ক্যানালের খাতে জল ঢালা মানেই ‘উত্তরবঙ্গের’ কৃষির জন্য দরকারি সেচ দেওয়া। এটা বর্তমান রাজ্য সরকারের উদ্দেশ্য।
এই ভাবে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের তিস্তা সংক্রান্ত বিবাদের চিহ্ন করে তোলা হয়েছে তিস্তার নদীখাত ও তিস্তার ক্যানালখাতকে। মুখ্যমন্ত্রীকে এই বিভাজনের শরিক করে ফেলা হচ্ছে ভুল তথ্য দিয়ে।
কেন?
যদি এটা প্রমাণ করা যায় যে, ক্যানাল-তিস্তার জল শুধুই উত্তরবঙ্গ পায় ও পাবে, তা হলে মুখ্যমন্ত্রী ক্যানাল-তিস্তাকে একটা প্রধান সেচ-কর্মসূচি হিসেবে প্রধান্য দেবেন। দিলে, ক্যানাল-তিস্তার কাজ আবার শুরু হবে। কী সেই কাজ? তিস্তার জলকে মহানন্দায় ফেলা। পশ্চিমবঙ্গের বড় খাল কাটা, ব্যারাজ তৈরি ইত্যাদির জায়গা আর বিশেষ কিছু বাকি নেই। সুতরাং, ক্যানাল-তিস্তাকে আবার উসকে তোলা হচ্ছে। তার সঙ্গে এও বলা হচ্ছে যে, ‘তিস্তা-মহানন্দা সংযোগকারী বেশ কিছু খাল সংস্কার না হওয়ায় এক দিকে যেমন পলি জমে জলধারণ ক্ষমতা কমেছে, তেমনই খালের কংক্রিটের পাড়গুলি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে।... ফলে পাড় ধসে পড়া বা এলাকা প্লাবিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে’ (আ বা প, ২৪-১০)। প্রমাণ ২০১০ সালের ফুলবাড়ি বন্যা, ২০১১ সালে মালবাজারে খালে ভাঙন ধরা। এ দুটো প্রমাণ কষ্টকল্পিত ও ভুল। বর্ষায় জল আটকে ‘বন্যা’ অখণ্ড বাংলার ভূগোলের সবচেয়ে স্বাভাবিক অবস্থা, ফুলবাড়ির বন্যা তেমনই একটা স্থানীয় ঘটনা। আর গাজোলডোবায় খালে জল ছাড়লে মালবাজারে খালে ভাঙন ধরে কী করে, সেটা বুদ্ধি ও ম্যাপের অগম্য। গাজোলডোবা খালের কাছাকাছি হতে পারে, কিন্তু খালে নদী-তিস্তাও নেই, ক্যানাল-তিস্তাও নেই। ওদলাবাড়ি আর মাল প্রশাসনিক ভাবে সন্নিহিত, ভৌগোলিক ভাবে নয়।
ক্যানাল-তিস্তার কংক্রিটের পাড় সারানো, পলি সরানো, এই কাজগুলির কথা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রশাসনিক বৈঠকে উঠলে বা ওঠালেই সন্দেহ হয়, মতলবটা কী? ক্যানাল-তিস্তা এতই ছোট যে, এ সব কাজ তো বিভাগীয় মেরামতি কাজ হিসেবেই করে ফেলা উচিত ছিল। সেই কাজকে মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত ঠেলা হল কেন, এরই তো তদন্ত করা উচিত।
রাজ্যের সব সমস্যার জন্য মুখ্যমন্ত্রী বামফ্রন্ট সরকারকে দায়ী করেন। ব্যতিক্রম তিস্তা-ব্যারাজ। অথচ তিস্তা-ব্যারাজ ও ক্যানাল বামফ্রন্ট সরকারের এক সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত কর্মকাণ্ড। এই কর্মসূচিতে ফ্রন্ট সরকারকে ফাঁসানো হয়েছিল সেই একই বুদ্ধিতে, যে মতলবি বুদ্ধি এখন মুখ্যমন্ত্রীকে ভজাচ্ছে ক্যানাল-তিস্তাকে প্রধান করে তুলতে।
বামফ্রন্টের আমলে ও এখন যাঁরা তিস্তা-ব্যারাজ তৈরিকে সমর্থন করেছিলেন ও করছেন, তাঁরা একটা নগণ্য তথ্য প্রকাশ করুন না। ক্যানাল-তিস্তা বহমান হওয়ার পর ক্যানাল এলাকায় গত ৩৩ বছরে কোন কোন মাসে, কত জল সেচের জন্য ছাড়া হয়েছে, আর এই ক্যানাল এলাকায় ওই ৩৩ বছরে চাষের কী বদল ঘটেছে, রবি-খরিফ চাষ কী বেড়েছে, যা অন্য জায়গায় বাড়েনি। চাষের গড় উন্নতিকে এই এলাকার উন্নতি বলে দেখালে চলবে না, ক্যানালের ফলে ফলনের কী বদল ঘটেছে, তার হিসেব চাই। সে হিসেব বের করা খুব কিছু কঠিন নয়।
মুখ্যমন্ত্রীর তিস্তা নীতি স্পষ্ট হোক না। তা হলে তো তিস্তা নিয়ে আন্তর্জাতিক বিসংবাদও দূর হতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী তিস্তা নিয়ে দল-নিরপেক্ষ একটি সম্মেলন ডাকুন। তাতে তিস্তা নিয়ে যাঁরা ভাবেন, তাঁদের সবাইকেই আসতে বলুন। আসুন তাঁরা, যাঁরা প্রতিদিন তিস্তার জলে পা ভেজান। সেই সম্মেলন যদি তাঁকে বলে, তিস্তা-ব্যারাজের ধারণাই ভুল, তা হলে মুখ্যমন্ত্রী তিস্তাকে তিস্তায় ফিরিয়ে দিন। প্রকাশ্যে ঘোষণা করে দিন— তিস্তা-ব্যারাজ ব্যারাজ হিসেবে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হবে। কিন্তু, যেহেতু ক্যানাল একটা কাটা হয়েছে, বাঁধানো হয়েছে, তাই জলপাইগুড়ির ছ’মাসি বর্ষার জল ওই খালে জমা থাকবে। ফলে তিস্তার প্রধান খাতে বন্যা আটকানো যাবে। আর শীতের ছ’মাস ওই ক্যানালে ও তার পাশে পর্যটনের নানা রকম ব্যবস্থা তৈরি করা হবে— হোটেল রিসর্ট সহ নানা রকম ব্যবস্থা।
একটা ব্যারাজকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে নিশ্চয়ই বুকে দম লাগে। কিন্তু একটা নদীকে নদীতে ফিরিয়ে দিলে ভগীরথতুল্য পুণ্য অর্জিত হয়। |