নির্ধারিত শব্দসীমা লঙ্ঘন করিয়া বাজির তাণ্ডব ঠেকাইতে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ নাগরিকদের শুভবুদ্ধি ও সচেতনতার কাছে বিনম্র, ‘করজোড়’ মিনতি করিয়াছে। ইহাতে চিঁড়াও ভিজিবে না, রাধাও নাচিবে না। তথাপি প্রতি বছর এই ধরনের আদিখ্যেতাই প্রত্যক্ষ করিতে নগরবাসী অভ্যস্ত হইয়াছেন। শব্দবাজির অত্যাচার হইতে জনপদকে মুক্ত করিতে এই বার উপরন্তু বাজির উৎসমুখ বন্ধ করার অর্থাৎ বাজি নির্মাণ কারখানাগুলিতে তালা ঝুলাইবার কথাও শুনা গিয়াছে। প্রস্তাব কিংবা উদ্যোগটিকে হাস্যকরই বলা যায়। প্রথমত, শব্দবাজির প্রধান উৎস এই রাজ্যে নহে। দ্বিতীয়ত, শব্দবাজি রাজ্যময় আগেই ছড়াইয়া পড়িয়াছে। উৎস বলিতে অবশ্য কেবল বাজি কারখানা নয়, সেই সঙ্গে বাজিবিক্রয় কেন্দ্রগুলিতেও নজরদারির কথা বলা হইয়াছে। পাশাপাশি, কর্তৃপক্ষের দাওয়াই: স্বীকৃত বাজি-বাজারের সংখ্যা বাড়াইয়া দেওয়া, যাহাতে ক্রেতারা আইনি বাজি কিনিয়া তৃপ্তচিত্তে ঘরে ফিরিয়া যান।
ইহা কেবল রসিকতা নয়, নিতান্ত বদরসিকতা। যাঁহারা বেআইনি বাজি ফাটান, তাঁহারা আইনি বাজির অভাবে কাতর হইয়া তাহা করেন না, জোর আওয়াজ করিতে চাহেন বলিয়াই বেআইনি বাজি কেনেন। পুরকর্তা, পুলিশ কিংবা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের আধিকারিকরা রাস্তাঘাটে চলাফেরা করেন কি না জানা নাই। করিলে জানিতেন, গোটা শহরই এখন বাজির লাইসেন্সবিহীন বাজার। সারা বছর যে দোকানিরা মণিহারি সামগ্রী কিংবা মরসুমি ফল বেচিয়া থাকেন, এক্ষণে তাঁহারাও অনেকে বাজি বিক্রয়ে ব্যস্ত। সব পাড়ার অধিকাংশ দোকান যেমন দোলের সময় আবির-রঙ বিক্রয় করে, বিশ্বকর্মা পূজার সময় ঘুড়ি-লাটাই, তেমনই কালীপূজার সময় বাজি বিক্রি করিয়া দুই পয়সা বাড়তি মুনাফার আশা রাখে। জনসাধারণ অধিকাংশত এই সব পাড়ার দোকান হইতেই প্রয়োজনীয় বাজি কিনিয়া থাকেন।
শব্দবাজিকে তাহার উৎসে আটকাইবার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কিন্তু তাহার অর্থ এই নয় যে, সেই কাজটি করিতে না পারিলে শব্দের উপদ্রব দমনের আর কোনও উপায় নাই। নির্ধারিত সীমার উপরে শব্দবাজি ফাটাইলে শাস্তিদানের আইন রহিয়াছে। পুলিশের কাজ আইন বলবৎ করা। পুলিশকে সর্বত্র সমস্ত আইনলঙ্ঘনকারীকে ধরিতে হইবে, এমনও নয়। ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’ কথাটি এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে প্রাসঙ্গিক। পুলিশ যদি কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীদের চিহ্নিত করিয়া তাহাদের শাস্তি মিটাইয়া দেয় এবং সেই বিচার ও শাস্তির সংবাদ যথেষ্ট ব্যাপক ভাবে প্রচার করে, যাহাতে জনসাধারণ জানিতে পারেন যে, নিষিদ্ধ শব্দবাজি ফাটাইলে ভবিষ্যতে তাঁহাদের কপালেও কঠোর শ্রম কারাদণ্ড রহিয়াছে, তাহা হইলেই ইন্দ্রজালের ন্যায় কাজ হইবে। যাঁহারা বেআইনি বাজি ফাটাইয়া উল্লাস করেন, তাঁহাদের স্বভাবত অসমসাহসী বলিয়া মনে করিবার কিছুমাত্র কারণ নাই, বরং পুলিশ তৎপর ও কঠোর হইলে তাঁহারা অত্যন্ত ভীত হইয়া পড়িবেন, ইহাই প্রত্যাশিত। তাঁহারা কালীপূজা তথা দেওয়ালির সময় আইন লঙ্ঘন করিয়া শব্দের তাণ্ডবে মত্ত হন, কারণ তাঁহারা জানেন, আইন ভাঙিলে কোনও শাস্তি হইবেন। দীর্ঘ প্রশ্রয়ই তাঁহাদের এই সাহস জোগাইয়াছে। সৎসাহস নয়, ইহা প্রকৃত দুঃসাহস। পুলিশ প্রশাসন ও তাহার পশ্চাদ্বর্তী রাজনীতি ইচ্ছা করিলেই এই দুঃসাহস বিনাশ করিতে পারে। করিবে কি না, তাহা অবশ্য অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন। |