কৃষ্ণের যে বাঁশি শুনিয়া শ্রীরাধা আকুল হইতেন, বাঁশির সেই সুর আসলে সংকেত। কৃষ্ণের উপস্থিতির সংকেত, মিলনের ডাক। প্রেমে যেমন, অর্থনীতির চৌহদ্দিতেও সংকেত অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ঠিক সুরটি না বাজিলে বার্তা পৌঁছায় না। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বর্তমান গভর্নর রঘুরাম রাজন গত দেড় মাসে সংকেত দেওয়ার কাজটি নিখুঁত ভাবে করিতে পারিয়াছেন। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে তাঁহার প্রথম নীতি নির্দেশিকায় তিনি রেপো রেট বাড়াইয়াছিলেন। অক্টোবরের শেষে ফের বাড়াইলেন। সমপরিমাণ, ০.২৫ শতাংশ। তাঁহার বাঁশি নির্ভুল সুরে বাজিতেছে। বাজার বুঝিতে পারিয়াছে, বৃদ্ধির মুখ চাহিয়া শিথিল আর্থিক নীতি বজায় রাখিবার দিন শেষ, ব্যাঙ্কের পাখির চোখ এখন মূল্যস্ফীতি। আপাতদৃষ্টিতে বিস্ময়কর লাগিতে পারে, কারণ পাইকারি মূল্যসূচক তেমন বাড়ে নাই। কিন্তু, বাজার খেয়াল করিবে, রাজন ভোগ্যপণ্য মূল্যসূচকের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়াছেন। ভারতের বাজারে আগুন লাগিয়াছে, সেই আগুনে সাধারণ মানুষ পুড়িতেছেন। রাজন ভোগ্যপণ্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণে আনিতে চাহেন। রাজনের, এবং তাঁহার নেতৃত্বে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের, এই একমুখী লক্ষ্যের কথা বাজার বুঝিতে পারিয়াছে। ব্যাঙ্ক আর্থিক বৃদ্ধির হারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে নারাজ, এই কথাটি স্পষ্ট হইবার পরেও বাজার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানায় নাই। ইহা তাৎপর্যপূর্ণ। বাজার নীতিনির্দেশকদের নিকট যতখানি সাহায্য প্রত্যাশা করে, তাহার অধিক প্রত্যাশা করে নীতির ধারাবাহিকতা, স্বচ্ছতা। রাজন এই ধারাবাহিকতা আনিয়াছেন। তাঁহার সিদ্ধান্ত লইয়া অবশ্য প্রশ্ন আছে। ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে যে অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতি চলিতেছে, তাহা মূলত খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে। সুদের হার বাড়াইয়া বাজারে টাকার জোগানে রাশ টানিলেও এই সমস্যার সমাধান হইবে না। তিনি বড় জোর চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারেন। কিন্তু, জোগানের সমস্যা না কমিলে ভোগ্যপণ্যের সূচক নিয়ন্ত্রণে আসিবে কি?
এই প্রশ্নটির উত্তর মুম্বইয়ে নাই, দিল্লিতে আছে, কিছুটা বিভিন্ন রাজ্যের রাজধানীতেও। জোগানের সমস্যা সমাধানের কাজটি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নহে, সরকারের। রাজন বস্তুত সরকারের একটি সুবিধা করিয়া দিয়াছেন— রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গতিপথ দ্ব্যর্থহীন ভাবে চিহ্নিত করিয়া দেওয়ায় সরকারও নিজের কর্তব্য বুঝিতে পারিবে। কেন পেঁয়াজের ন্যায় পণ্যের দাম মাঝেমধ্যেই এমন অস্বাভাবিক রকম চড়িয়া যায়, সেই কারণ সরকার বাহাদুরের অজ্ঞাত নহে। এই জাতীয় পণ্যের কোনও যথার্থ জোগান-শৃঙ্খল গড়িয়া উঠে নাই। তাহার অনেকগুলি কারণের মধ্যে একটি হইল, ভারতে বাহ্যিক পরিকাঠামোর মান তলানিতে ঠেকিয়াছে। তাহাতে যে শুধু পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধিই ঘটিতেছে, তাহা নহে— শিল্প-বিনিয়োগ সম্পূর্ণ অকুশলী হইয়া উঠিয়াছে।
এই অকুশলতার অন্য প্রমাণও সুস্পষ্ট। ভারতে, এই আর্থিক ডামাডোলের বাজারেও, অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের হার বেশ চড়া। বিনিয়োগের হারও নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর নহে। তবুও এই দেশে বর্তমান আর্থিক বৎসরে, অথবা অদূর ভবিষ্যতে আর্থিক বৃদ্ধির হার পাঁচ শতাংশের বেশি হইবার আশা কেহই করিতেছেন না। কেন? তাহার কারণ, এই দেশে বিনিয়োগ কুশলী নহে। এই সমস্যার প্রধান দায় সরকারের। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকেই একমাত্র লক্ষ্য করিয়া সরকারের কাজ সহজ করিয়া দিয়াছে সরকার বাকি সমস্যাগুলি লইয়া ভাবিতে পারে। পরিকাঠামোর উন্নতিসাধন তো বটেই, তাহা ভিন্ন যে প্রকল্পগুলি ছাড়পত্রের অভাবে আটকাইয়া আছে, সেগুলির ব্যবস্থা করা, কয়লাখনি বণ্টনের ন্যায় সিদ্ধান্ত ত্বরান্বিত করা, ভর্তুকির রাশ টানা সরকারের কাজের অভাব নাই। তবে অদূরে ভোট। সে সকল ভাবিবার সময় কি আর সরকারি কর্তাদের আছে? |