ওই তো, ওই তো সেই চেনা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে তিনি। কত দিন পর, আবার...। ড্রেসিংরুমের দিকে তাকিয়ে মুষ্টিবদ্ধ দু’টো হাত আহত সিংহের গর্জন শোনাচ্ছে। হেলমেট পরা মুখটাকে দেখা গেল, আকাশে কী একটা যেন খুঁজছে। ’৯৯ বিশ্বকাপে ব্রিস্টল থেকে যা সেঞ্চুরির পর নিয়ম তাঁর জীবনে।
বুধবার তো সেঞ্চুরি করেননি। শুধু টিমকে জিতিয়েছেন। তা হলে? আজও কি আকাশে প্রয়াত পিতৃদেবকেই খুঁজছিলেন সচিন রমেশ তেন্ডুলকর?
আরে, মাঠ থেকে কাকে ও ভাবে কাঁধে করে নিয়ে আসছেন হরিয়ানা ক্রিকেটাররা? বাজে প্রশ্ন। শিবাজি পার্কের প্রখ্যাত মরাঠি ছাড়া আজ আর কেউ সম্ভব? বিশ্বকাপ জেতার পর ওয়াংখেড়ে দেখেছে, বিরাট কোহলিদের ভবিষ্যৎ-প্রজন্মের কাঁধে চড়ে তাঁর ‘ভিকট্রি ল্যাপ’। কিন্তু ওয়াংখেড়ে কখনও দেখেনি, মাঠে চার দিন ধরে যুদ্ধরত প্রতিপক্ষ যোদ্ধাদের কাঁধে চড়ে বাইশ গজ থেকে বেরোচ্ছেন সচিন!
ধুর, আজ আবার প্রতিপক্ষ! কাঁধের শরীরটা তো ‘দেশ’, প্রতিদ্বন্দ্বী কোথায়? রঞ্জি ট্রফির রাজ্যে-রাজ্যে অসিযুদ্ধ ও সব গৌণ। মুখ্য অবসরের প্রাক্কালে মহানায়ককে ঠিকঠাক বিদায়ী সংবর্ধনা দেওয়াটা।
মাঠ ছেড়ে বেরবো-বেরবো করেও কিছুতেই সেটা হচ্ছে না। ড্রেসিংরুমের দিকে আবেগে আপ্লুত সাড়ে পাঁচ ফুটের শরীরটা হাঁটতে শুরু করতেই ছুটে এলেন স্টার স্পোর্টসের ক্যামেরাম্যান। কী ব্যাপার? না, ক্যামেরার লেন্সে একটা অটোগ্রাফ চাই! একটু পর পুরনো বন্ধু বিবেক রাজদানের মাইক্রোফোনে ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ “খুব আশা করে লাহলি এসেছিলাম, ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্টের আগে ভাল প্রস্তুতি পাব বলে। লাহলিকে ধন্যবাদ, সেটা পেয়েছি।”
আশ্চর্য। কর্কশ দেশজ মিডিয়ার চোখেও তখন জল! কিছু করার নেই। চিরবিদায়ের বাকি তো মোটে আর উনিশটা দিন।
এবং বুধবারের পর থেকে ঘরোয়া ক্রিকেটের আকাশেও আর কখনও দেখা যাবে না সচিন রমেশ তেন্ডুলকরকে। ’৮৮-র ওয়াংখেড়েতে সেঞ্চুরি দিয়ে যে বৃত্তের শুরু হয়েছিল, তা শেষ হল আজ, লাহলিতে। অপরাজিত ৭৯-র অমর ইনিংস দিয়ে। যা এক দিকে যেমন তাঁর বিদায়লগ্নের বোধন ঘোষণা করে গেল, তেমনই অকাল দীপাবলির প্রেক্ষাপট তৈরি করে ফেলল ইডেন গার্ডেন্সের জন্য। |
সকালে মুম্বইকে জিতিয়ে |
|
সচিনের সোনার শেষ |
বিশ্বকাপ
ওয়াংখেড়ে। এপ্রিল, ২০১১।
ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে ৬ উইকেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন ভারত।
সচিন ১৮।
|
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ টি-টোয়েন্টি
কোটলা। অক্টোবর ২০১৩।
ফাইনালে রাজস্থান রয়্যালসকে ৩৩ রানে
হারিয়ে জয়ী মুম্বই ইন্ডিয়ান্স।
সচিন ১৫। |
ওয়ান ডে
বনাম পাকিস্তান। মীরপুর, মার্চ ২০১২।
৩৩০ তাড়া করে ছ’ উইকেটে জয়ী।
সচিন ৫২। |
আইপিএল
মে ২০১৩, ইডেন।
ফাইনালে চেন্নাই সুপারকিংসকে
হারিয়ে
২৩ রানে জয়ী মুম্বই।
সচিন চোটের জন্য খেলেননি। |
রঞ্জি ট্রফি
বনাম হরিয়ানা।
অক্টোবর ২০১৩, লাহলি।
মুম্বই ৪ উইকেটে জয়ী।
সচিন ৭৯ ন.আ। |
|
সচিনের বিএমডব্লিউ তখনও চৌধুরী বংশীলাল স্টেডিয়ামের গেট ছেড়ে বেরিয়ে যায়নি। আচমকা এক সিএবি কর্তার উত্তেজিত ফোন, “জিতিয়ে দিল তো, অ্যাঁ? এ বার দেখবেন, কলকাতায় কী হয়!” দেখার কিছু নেই। আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি, শহরজুড়ে সচিনের ট্যাবলয়েড, গ্যালারিতে তাঁর মুখোশ নানাবিধ পরিকল্পনায় ইতিমধ্যেই ইডেনে ঠাসা শব্দব্রহ্মের বন্দোবস্ত হয়ে আছে। তার মধ্যে সচিনের অপরাজিত ৭৯ করে কলকাতায় ঢোকা মানে, দীপাবলির আগেই শহরের আবেগের হাউইয়ে আগাম আগুন ধরিয়ে দেওয়া।
কিন্তু লাহলির বাইশ গজে তাঁকে ঘিরে নানা রঙিন টুকরোগুলো যদি ইডেন বা ওয়াংখেড়েকে কড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলে দেয়, খুব অবাক হওয়ার থাকবে না। এ দিন সকালে সচিন যখন ব্যাট করতে ঢুকছেন, গোটা টিম নিয়ে তাঁকে আরও একবার ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে অজয় জাডেজা। দেখেশুনে অবাক সচিন নাকি এক সময়ের জাতীয় দলের সতীর্থকে জিজ্ঞেস করে ফেলেন, “রোজ এটা কী করছ? গত কালই তো দিলে!” শুনে হরিয়ানা ক্যাপ্টেনের অনুনয়, “আজই তো শেষ। এটা হতে দাও।”
জাডেজা এতটুকু ভুল নন। উন্মত্ত আবেগ বাদ দিয়ে যদি শুষ্ক ক্রিকেটীয় যুক্তিতেও ঢুকতে হয়, তা হলেও বলতে হবে বুধবারের ইনিংসের জন্য সচিনের টুপি খুলে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন প্রাপ্য। রঞ্জির চতুর্থ দিনেও লাহলি পিচের যা চড়া মেজাজ দেখা গেল, তাতে ডেল স্টেইনদের দেশে উড়ে যাওয়ার আগে ভারতীয় দল এখানে অনায়াসে শিবিরের ব্যবস্থা করতে পারে। করলে, লাভও আছে। শনশনে হাওয়ায় তীব্র গতিতে ছুটে আসছে এক একটা ডেলিভারি। মহানায়ককে নিরন্তর প্রলুব্ধ করা চলছে ‘অন দ্য রাইজ’ ড্রাইভ মারার। বহু দিন পরে রোমাঞ্চকর এক যুদ্ধক্ষেত্র পেয়ে জেগে উঠেছেন অজয় জাডেজা নামক এক প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক। নতুন বল নিলেন। তিনটে স্লিপ, গালি, পয়েন্ট দিয়ে চক্রব্যূহ সৃষ্টি করে ফেললেন সচিনের জন্য। সামান্য একটা ভুলের আশাবাদে। জাডেজা জানতেন, ওই একটা উইকেট পেলেই তাঁর চলবে। জানতেন, টার্গেটের পাঁচ রান আগেও সচিনের চলে যাওয়া মানে ম্যাচের বেঁচে থাকা। কিন্তু উত্তরে বাকি উনচল্লিশ তুলে দেওয়াই শুধু নয়, প্রায় প্রত্যেকটা বলের পরে মাঝ পিচ পর্যন্ত হেঁটে সচিন দেখে আসছিলেন, পিচে কোনও স্পট তৈরি হয়েছে কি না! যেখান থেকে বল আচমকা লাফিয়ে উঠতে পারে। যেতে পারে উইকেট। ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর সর্বশেষ মহাযুদ্ধে নেমে কতটা একাগ্র ছিলেন সচিন তেন্ডুলকর, এর পরেও বোঝানোর দরকার পড়ে?
পরে জাডেজা হাসতে হাসতে স্বভাবসিদ্ধ ফুর্তির মেজাজে বলছিলেন, “ভগবানের সঙ্গে লড়ে কে জিতবে!” মাথার চুলের পঁচাত্তর ভাগ পেকে যাওয়া হরিয়ানা অধিনায়কের এটাও মনে হচ্ছে যে, সচিনের ৭৯ নট আউট মানে ‘ইনফিনিটি’! আর চল্লিশটা রান বাকি থাকলে সেঞ্চুরি হত, সচিনের ইনিংস এগোত নিজস্ব নিয়মে। কেউ আটকাতে পারত না। এটাও ঠিক, ইদানীং ভিতরে ঢুকে আসা ডেলিভারি বিভিন্ন মহলে তাঁকে নিয়ে প্রচুর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু আজকের লাহলিতে যে সচিনকে দেখা গেল, তাঁকে দেখে কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটের ‘ভীষ্ম’ বলেই মনে হল। যাঁর ‘জীবন’ দেওয়া না দেওয়া, সবই নির্ভর করে নিজের উপর। সংক্ষেপে, ‘ইচ্ছামৃত্যু’!
এবং আজ থেকে ভারতবর্ষের ম্যাপেও বোধহয় লাহলি নামক কোনও জায়গার আর ‘মৃত্যু’ হবে না। হরিয়ানার প্রত্যন্ত গ্রাম এত দিন দেখেনি ক্রিকেট রোমান্স কাকে বলে, সামনে ক্রিকেটের জীবন্ত কিংবদন্তিকে দেখলে, তাঁর ‘উইলো’র আওয়াজ কানে শুনলে, অনুভূতিটা ঠিক কেমন হয়। শুধু একটাই যা ব্যাপার। আফসোস বললে, আফসোস। আক্ষেপ বললে, আক্ষেপ। মোহিত শর্মাদের কেন, সমগ্র ভারতের বোলারকুলেরই বোধহয় দুঃখটা ইহকাল থেকে যাবে।
রঞ্জি ট্রফিতে ক্রিকেট-দেবতার স্মারক-উইকেটটা তো কারও আর নেওয়া হল না! |