|
|
|
|
লাহলির শেষ যুদ্ধ সচিনের ব্যাটে
রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় • লাহলি |
আর কত দিন?
সেই ’৮৮ থেকে তো চলছে। গুজরাতের বিরুদ্ধে রঞ্জি ট্রফিতে তাঁর অভিষেক-মুহূর্ত থেকে আজ, ২০১৩। মধ্যবর্তী সময়ে পঁচিশটা বসন্ত পেরিয়েছে, ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে পরিবর্তন এসেছে, দিল্লি মসনদে ন’জন রাজনৈতিক নেতা প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেছেন, শুধু তাঁর জীবনে কোনও ব্যতিক্রম নেই। আজ দেশ, কাল রাজ্য দল, পরশু আইপিএল টিম— দীর্ঘ পঁচিশ বছরের ক্রিকেট কেরিয়ারে যত বার তিনি ব্যাট হাতে নেমেছেন, টিমের বাকি দশ জন যেন তাঁর মুখাপেক্ষী হয়ে থেকেছে।
’৮৮-র শীতে সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের ক্রিকেট-জীবন ঠিক যে ভাবে শুরু হয়েছিল, আজ ক্রিকেট বিশ্ব থেকে অবসরের প্রাক্-লগ্নে পৌঁছেও এক। প্রথম রঞ্জিতে দুর্ধর্ষ সেঞ্চুরি করেছিলেন, বিদায়ী রঞ্জিতে আপাতত অপরাজিত হাফসেঞ্চুরি। এবং আজ বুধবার, লাহলি নামক ভারতের এক অখ্যাত গ্রামে সচিন তেন্ডুলকরের ব্যাট বাঁচালে মুম্বই ‘বাঁচবে’, নইলে নয়।
দিনের শেষের স্কোরবোর্ড বলছে সচিন তেন্ডুলকর নট আউট ৫৫। মঙ্গলবার টিভি রিমোট অন না করা ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে হতে পারে যাক, অন্তত অন্তিম সিরিজে মহানায়কের ব্যাট আবার নিজস্ব ফর্ম খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু সেটা অর্ধসত্য। স্কোরবোর্ড বলবে না, কী ভাবে লাহলি পিচ নামক এক ধুরন্ধর প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে নেমে নিজের ব্যাট থেকে রোমান্স ছেঁটে ফেলে কার্যকরিতাকে বেছে নিতে হয়েছে স্বয়ং ক্রিকেট-দেবতাকে। বলবে না, কী ভাবে তাঁকে রক্তাক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে চার ঘণ্টার চিত্রনাট্যের প্রতিটা মুহূর্তে। এবং স্কোরবোর্ড এটাও বলবে না যে, সচিন রমেশ তেন্ডুলকর মর্যাদাযুদ্ধের সবে অর্ধেকটা পথ পেরিয়েছেন। বাকি অর্ধেক এখনও বাকি, যেটা সম্পন্ন হবে বুধবার সকালে। কুয়াশা পরিবৃত ব্যাটসম্যানদের মারণ-পিচে! |
রঞ্জিতে এখন পর্যন্ত (১৯৮৮-২০১৩) |
ম্যাচ ৩৮, ইনিংস ৫৭, রান ৪২৫৭ |
সর্বোচ্চ ২৩৩, নঃআঃ গড় ৮৫.১৪ |
সেঞ্চুরি ১৮, হাফসেঞ্চুরি ১৯, শূন্য ১ |
|
জিততে হলে ৩৯,
উইকেট হাতে ৪
সচিন ব্যাটিং ৫৫ |
|
যখন বল নড়বে, পেসারের বাউন্সার ভিজে উইকেটে শরীরের দিকে ছুটে আসবে প্রচণ্ড গতিতে, একশো শতাংশ নিশ্চিত না হয়ে ড্রাইভ মারতে গেলে যখন পরিণতি দাঁড়াবে ব্যাটসম্যানের অবধারিত ‘মৃত্যু’, তখন ওই অবস্থায় দরকার পড়বে উনচল্লিশটা রান। উইকেট কিন্তু হাতে চার এবং মুম্বই ব্যাটিংয়ের শেষ স্বীকৃত জুটি কিন্তু এটাই, সচিন-কুলকার্নি।
পারবেন তেন্ডুলকর?
সন্ধের দিকে কেউ কেউ বলছিলেন, সচিনের ভাগ্য না দিলীপ বেঙ্গসরকরের মতো হয়! পুলিশের লাঠির মার সহ্য করে এ দিন তাঁকে দেখতে ছুটে আসা লাহলির আম-আদমিকেও না শেষ পর্যন্ত দুঃখ পেতে হয়। ’৯১-এর রঞ্জি ফাইনালে বেঙ্গসরকরের উল্টো দিকে এই হরিয়ানাই ছিল। তবে সেটা কপিল দেবের, অজয় জাডেজার নয়। এবং মুম্বইকরকে হারতে হয়েছিল শুধু নন-স্ট্রাইকার প্রান্তে যোগ্য সঙ্গীর অভাবে। সে দিনের হরিয়ানা-মুম্বই রঞ্জি ফাইনালের হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়া ম্যাচে বেঙ্গসরকরকে দেখতে হয়েছিল কী ভাবে উল্টো দিকে একের পর এক উইকেট পড়ছে, আর একটু একটু করে দূরে সরছে কপিলের টিমকে হারিয়ে রঞ্জি জয়ের স্বপ্ন।
আবে কুরুভিল্লার শেষ উইকেটে পড়ার পর সে দিন কেঁদে ফেলেছিলেন বেঙ্গসরকর। কারণ, মাত্র দু’রান বাকি থাকতে কুরুভিল্লা-পতনে মুম্বই ইনিংসটা শেষ হয়ে যায়। ঐতিহাসিক ওই রঞ্জি ফাইনালে মুম্বই টিমলিস্টে সচিন তেন্ডুলকরের নামও ছিল, আর তার পর আবার লাহলিতে হরিয়ানার বিরুদ্ধে তিনি নামলেন। এবং বুধবার মহানায়কের মুখে হাসি দেখা যাবে না হতাশা, চব্বিশ ঘণ্টা আগে বলা না গেলেও আশ্চর্য একটা মিল পাওয়া যাচ্ছে।
সচিনের প্রেক্ষাপটও অনেকটা বাইশ বছর আগের দিলীপ বেঙ্গসরকর-সম! |
লাহলির ড্রেসিংরুমে চলছে কেক খাওয়ার পালা। বুধবারও কি দেখা যাবে উৎসবের এই ছবি? |
ম্যাচটা তিনি আজই শেষ করে দিতে পারতেন, পারলেন না উল্টো দিকে পরের পর উইকেট পড়তে থাকায়। যা এ দিন বিকেল পর্যন্ত চলল অবিরাম। কেউ অবিশ্বাস্য থ্রোয়ে রান আউট, কেউ বোল্ড— যা শেষ পর্যন্ত সচিন রমেশ তেন্ডুলকরকেও বাধ্য করল সংহারের পথে না গিয়ে রক্ষণের রাস্তা ধরতে। কী করবেন, শেষ তিনটে উইকেট তো চলে গেল তিরিশ রানের মধ্যে, সব মিলিয়ে পড়ল ছ’টা।
একটা সময় পর্যন্ত মনে হচ্ছিল, ম্যাচ কোনও ভাবেই চতুর্থ দিন সকালের মুখ দেখছে না, সচিনও বিদায়ী টেস্ট সিরিজের আগে মহানায়কীয় প্রত্যাবর্তন ঘটিয়ে মুম্বইয়ের ফ্লাইট ধরবেন রাতে। দুপুর একটা পঁচিশ থেকে শুরু করে বিকেল পাঁচটা দশ— মাঝের সময়ে তাঁকে বিবিধ পরীক্ষার মধ্যে ফেলেও তো ডাহা ‘ফেল’ হরিয়ানা পেস ব্যাটারি। একটা সময় ওভার পিছু একটা বাউন্সার তাঁকে দেওয়া হল, হরিয়ানা অধিনায়ক সচিনকে দ্বিতীয় বারের জন্য দেখে তাঁর প্রথম ইনিংসের ঘাতক মোহিত শর্মাকে দিয়ে বল করালেন টানা বারো ওভার। সচিন বোধহয় বুঝেছিলেন, এমন কঠিন উইকেটে শিল্প নয়, দরকার কাঠিন্য। খুব সম্ভবত তাই ফিল্ডারকে দাঁড় করিয়ে রেখে অনিন্দ্যসুন্দর কভার ড্রাইভ একটার বেশি বেরোয়নি। প্যাডল সুইপের টাইমিং গণ্ডগোল করছে দেখে একটা সময় সেটাও বাদ দিয়ে দিলেন। বরং এল পরের পর ফ্লিক। ফ্রন্টফুটে যাওয়ার বদলে চলে গেলেন ব্যাকফুটে। মঙ্গলবারে তাঁর লাহলির নট আউট ৫৫ কোনও ভাবে তাঁর ঘরোয়া ক্রিকেটে করা দৃষ্টিনন্দন ইনিংসগুলোর তালিকায় ঢুকবে না। বাকি উনচল্লিশ রান একা করলেও তাঁর পক্ষে বিদায়ী রঞ্জি ইনিংসে আর সেঞ্চুরি সম্ভব নয়। কিন্তু বুধবার যদি একটা অপরাজিত পঁচাত্তর বা আশি করে মুম্বইকে জীবনদায়ী ওষুধের সন্ধান দিয়ে যেতে পারেন সচিন, যদি জেতাতে পারেন, তা হলে মর্যাদার স্কোরবোর্ডে ওই ইনিংসের রান হবে বোধহয় দেড়শোরও বেশি।
প্রায়ান্ধকার স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে মোহিত শর্মা তো আর এমনি এমনি বলে গেলেন না যে, বুধবার তাঁদের মাত্র একটা উইকেট চাই, বাকিদের নিয়ে নাকি না ভাবলেও চলবে! |
পুরনো খবর: পানিপথের পাশে সচিনের মহাযুদ্ধ |
|
|
|
|
|