প্রবন্ধ ২...
শুধু মালালাকে ধরে এগনো যাবে কি
গুল মাকাই রোজই ডায়রি লিখত— মাত্র তিন-চার স্তবক। কখনও একটি বা দুটি। অতি সহজ সরল জবান। স্কুলে যেতে যে কতটা ভাল লাগে তা লিখত গুল মাকাই। শহরে তালিবানি ফতোয়ার জন্য স্কুল যেতে পারবে, কি পারবে না, সে নিয়ে তার আশঙ্কার কথা বারে বারে ফুটে উঠেছে। নিজের কাছেই জানতে চাইত, কেন ওর ভাই স্কুলে যেতে পারবে আর ও কেন পারবে না। লিখত গোলাগুলির শব্দে রাতে ঘুম না হওয়ার বা দুঃস্বপ্নের কথা। বিদেশি সংবাদমাধ্যমের উর্দু ওয়েবসাইটে শহরের কোনও মেয়ের একটি ডায়রি প্রকাশিত হচ্ছে, আর তা নিয়ে বাজার-হাটে আলোচনা হচ্ছে, বাবার কাছে শুনে গুল মাকাই খুবই খুশি আর উত্তেজিত।
২০০৮ সালে মৌলানা ফজলুল্লাহ্-র নেতৃত্বে পাকিস্তানি তালিবানের একটি শাখা দেশের উত্তর-পশ্চিমের সোয়াট উপত্যকা দখল করে। পাখতুন জাতি-অধ্যুষিত এই সোয়াট উপত্যকা চিরকালই শিক্ষার দিক থেকে পাকিস্তানের বাকি অংশের তুলনায় এগিয়ে ছিল। এখানে মেয়েদের শিক্ষার হার ছিল খুবই উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানি রাষ্ট্রের নীরব দর্শক-জনিত ভূমিকার সুযোগে তালিবানরা সোয়াট উপত্যকাকে তাদের একটি মুক্তাঞ্চলে পরিণত করে এবং কট্টর ইসলামি শরিয়তি আইন প্রণয়নের নামে মেয়েদের লেখাপড়া নিষিদ্ধ করে। তারা প্রায় ১৫০টি স্কুল বোমা মেরে ধ্বংস করে দেয়, যেখানে মেয়েরা লেখাপড়া করতে যেত। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ কী করে বাস করছেন, সেটি জানার জন্য বি বি সি-র উর্দু ওয়েবসাইট একটি উদ্যোগ নেয়।
তারা চেষ্টা করে কোনও এক শিক্ষিকাকে দিয়ে একটি নিয়মিত ডায়রি লেখাতে। তালিবানি দাপটে মেয়েদের শিক্ষার ওপরে কী প্রভাব পড়ছে, সেটা ধরাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। পরিচিতি গোপন রাখার আশ্বাস সত্ত্বেও তেমন কোনও শিক্ষিকা পাওয়া যায়নি যিনি এমন একটি ডায়েরি লিখবেন। সেই সময় পেশওয়ারের সংবাদদাতা জানান, তাঁর স্কুল শিক্ষক এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ১৩ বছরের মেয়েকে দিয়ে একটা ডায়রি লেখানো সম্ভব। তখন আমি বিবিসিতে কর্মরত। যেহেতু এক বালিকাকে অতি সংবেদনশীল বিষয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাই নিয়ম মাফিক সম্পাদকীয় অনুমতির জন্য দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়া বিভাগের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে বিষয়টি আমার কাছে আসে। স্থির হয়, সেই বালিকার পরিচিতি গোপন রাখার জন্য লন্ডনে সম্পাদকীয় মূল দফতরে কেউ তার নাম জানবে না। তার নাম জানতেন একমাত্র সেই পেশওয়ারের সংবাদদাতা। বালিকার ছদ্মনাম দেওয়া হয় গুল মাকাই।
২০০৯-এর জানুয়ারি থেকে মাস তিনেক প্রতি সপ্তাহে এই ডায়রি প্রকাশ করা হয়। কিন্তু তার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সোয়াট উপত্যকায় অভিযান শুরু করে এবং মিনগোরা থেকে বাসিন্দারা সরে আসতে বাধ্য হন। গুল মাকাই আর তার পরিবারকে এই রাস্তা নিতে হয়। এরই ভিতর হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া সারবস্তু এবং ইংরেজি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হওয়ার কারণে অচিরে বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে গুল মাকাইয়ের ডায়রি সংবাদ হিসেবে জায়গা করে নেয়।
এর পরে ২০১১ সালে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমে দেখতে পাই মালালা ইউসুফজাই নামে এক কিশোরী নিয়মিত সাক্ষাৎকার দিচ্ছে আর জানাচ্ছে যে সে-ই ছিল গুল মাকাই। গুল মাকাইয়ের মালালা হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমের প্রচারের আলো ওর ওপর প্রবল ভাবে এসে পড়ে। দেখে চিন্তিত হয়েছিলাম, কেন ওর পরিবার এমন সিদ্ধান্ত নিল। ওই ডায়রি যে আলোড়ন ফেলেছিল, তাতে ওই পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ ছিল।
শেষ পর্যন্ত সেটাই সত্যি হল। স্কুল থেকে ফেরার পথে মালালা আর তার দুই বান্ধবী তালিবানের গুলিতে জখম হয়। অলৌকিক ভাবে মাথায় গুলি নিয়ে মালালা বেঁচে থাকে এবং সমগ্র বিশ্বের নজর পড়ে সোয়াট উপত্যকা এবং ওখানে দাপিয়ে বেড়ানো তালিবানের ওপর। মানুষ এখন জানেন কী ভাবে মাথায় অস্ত্রোপচারের পরে মালালা সুস্থ হয়ে পাকিস্তান ও পিছিয়ে থাকা দেশগুলির মেয়েদের শিক্ষা প্রসারের মুখপাত্র হয়ে উঠেছে।
ক্রিস্টিনা ল্যাম্ব-এর সহযোগিতায় মালালার আত্মজীবনী প্রকাশের পরে আবার সে প্রচারের প্রখর আলোয়। প্রেসিডেন্ট ওবামা ও তাঁর স্ত্রী মিশেল হোয়াইট হাউসে তাকে আমন্ত্রণ করছেন; নিমন্ত্রণ করছেন ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথও। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশনে মালালা মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে ভাষণ দিয়েছে; নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে সে।
আর অন্য দিকে, পাকিস্তানে চলছে ষড়যন্ত্র খোঁজা। মালালাকে নাকি পশ্চিমি কোনও দেশের গুপ্তচররা শিশু বয়েসে মিনগোরাতে রেখে গিয়েছিল ভবিষ্যতে পাকিস্তানের দুর্নাম করার জন্য। এটাও বলা হচ্ছে, মাথায় গুলি লাগা থেকে অস্ত্রোপচার— গোটাটাই সাজানো! পাকিস্তানি সমাজের এমনই করুণ অবস্থা, যে এই ধরনের চরম আজগুবি সব গুজব আপাত নির্ভরযোগ্য প্রধান সংবাদপত্রে জায়গা পাচ্ছে। কিছু পাকিস্তানি সাংবাদিক মালালার পিতার উচ্চাশার কথাও উল্লেখ করে চলেছেন।
১৬ বছরের এক কিশোরীকে নিয়ে এই কাড়াকাড়ির জন্য পশ্চিমি দেশগুলির উদ্দেশ্য নিয়ে ইতিমধ্যেই বিতর্ক উঠেছে। এরা ‘পিছিয়ে’ থাকা একটি সমাজের একটি মেয়ের ‘মহান রক্ষাকর্তা’র ভূমিকা নিচ্ছে কি না, সেটা যেমন একটি দিক, অন্য দিকে আছে— পশ্চিমের সঙ্গে ইসলামের সংঘাতের ভূগৌলোকিক রাজনীতি। মালালা বিশ্ব রাজনীতির খেলায় ঘুঁটিতে পরিণত হয়ে গেছে কি না, এটাও অনেকে ভাবছে।
মালালার ডায়রি পড়ে বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, সে অতি বুদ্ধিমতী, সপ্রতিভ, উৎসুক এক কিশোরী। গুল মাকাইয়ের মালালা হয়ে আত্মপ্রকাশ যে তাকে একটা বড় বিপদের মুখে দাঁড় করাবে, সেটা সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়। তাকে এই বয়সে এই ভাবে একটি রাজনৈতিক অঙ্গনে তুলে দেওয়া বা পাদপ্রদীপের সামনে নিয়ে আসার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা ও নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
ধর্মীয় মৌলবাদের মোকাবিলায় পাকিস্তানি রাষ্ট্রের ব্যর্থতা নতুন নয়। আশির দশক থেকে পাকিস্তান-আফগানিস্তানে পশ্চিমের দেশগুলির অতি সংকীর্ণ বিদেশ ও জাতীয় নিরাপত্তা নীতি গোটা অঞ্চলটিকে অস্থির করে তুলেছে আর শ’য়ে শ’য়ে মানুষকে কট্টর মৌলবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি আরও অনেক কিশোরকিশোরীকে জীবন-মরণের সংকটে এনে দাঁড় করাচ্ছে প্রতি দিন। বিশদ ভাবে তো দূর অস্ত্, পাদটীকা হিসেবেও এরা কোনও প্রতিবেদনে স্থান পায় না। যেমন মালালার সঙ্গে ওর আরও যে দুই বান্ধবী তালিবানের গুলিতে জখম হয়েছিল, তাদের কোনও খবর নেই।
কেন মালালাকে গুল মাকাই হিসেবে জনসমক্ষে আসতে হল, আর কী ভাবে ওই অঞ্চলের সামাজিক আর রাজনৈতিক ব্যাধি দূর করা যায়, সে বিষয়ে চর্চার বিশেষ কোনও প্রয়াস চোখে পড়ে না। এটা না করে শুধু মালালাকে ধরেই পশ্চিমি জগতের প্রগতিশীল অংশ নিজেদের বিবেক দংশনের জ্বালা প্রশমন করছে আর রাজনীতির হোতারা ‘ইসলাম বনাম পশ্চিমি সভ্যতা’র লড়াইয়ের যৌক্তিকতাকে খুবই সূক্ষ্ম ভাবে প্রতিষ্ঠা করে চলেছেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.