প্রবন্ধ ১...
গণতন্ত্র ওরফে সংখ্যাগুরুর শাসন
মুম্বইয়ের কুরলায় তাঁর অফিসঘরের মধ্যে শাহিদ আজমিকে কারা খুন করে রেখে গিয়েছিল, সেই রহস্যটার এখনও কোনও সমাধান হয়নি। সেটা ছিল ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। তার পর সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে গেছে, আরব সাগর দিয়ে আরও অনেক জল বয়ে গেছে, বর্ষার বৃষ্টিতে মুম্বই শহর আরও ক’বার বানভাসি হয়েছে, আরও দু’বার মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী বদলেছে, বলিউডের পাওয়ার লিস্টে শাহরুখ খান আবার পয়লা নম্বর জায়গাটা ফিরে পেয়েছেন, সচিন তেন্ডুলকরের রিটায়ারমেন্টের সরকারি ঘোষণা হয়ে গেছে, কিন্তু এই সাড়ে তিন বছরে শাহিদ আজমি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত বিশেষ কিছু এগোয়নি। আন্ডারওয়ার্ল্ডের দু’একটি নাম আলগোছে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে, হাতে গোনা দু’একটা মানবাধিকার সংগঠন মাঝেমধ্যে খানিকটা হইচই করেছে, কিন্তু আম-মুম্বইকরদের তাতে বিশেষ কিছু যায়-আসেনি। বরং এ রকম একটা ধারণাই ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে— দিনরাত সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে ওঠাবসা থাকলে এমনটাই তো হবে! তা ছাড়া, লোকটা নিজেই সন্ত্রাসবাদী ছিল। সীমান্তের ওপারে জিহাদি ট্রেনিং নিতে গিয়েছিল। টাডায় ফেঁসে সাত বছর জেল খেটেছে। ছাড়া পেয়ে টেররিস্টদের পরিত্রাতা হয়েছিল! এর পর যেটুকু অনুচ্চারিত থেকে যায়, সেটা হল— মরেছে, আপদ গেছে!
হ্যাঁ, মহারাষ্ট্র পুলিশ প্রশাসনের কাছেও প্রায় আপদের মতোই ছিলেন আইনজীবী তথা মানবাধিকার কর্মী শাহিদ আজমি। তিহাড় জেল থেকে বেরিয়ে আইন পাশ করে, মাত্র সাত বছরের কেরিয়ারে ১৭ জন বন্দিকে বেকসুর খালাস করিয়েছেন তিনি। এরা প্রত্যেকেই সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে, ‘টাডা’, ‘মোকা’ ধরনের নানা রকম দেশরক্ষা আইনের কবলে মাসের পর মাস বিচারাধীন বন্দি হিসেবে বিভিন্ন জেলে সাজা খেটেছে। পুলিশ তেমন কোনও (বা কোনও রকম) প্রমাণ ছাড়াই, স্রেফ সন্দেহের বশে এদের ফাটকে পুরেছিল, তার পর পুলিশ হেফাজতে সেই সন্দেহটাকে সত্যি প্রমাণ করার জন্য প্রচুর কসরত চলে; তার পরেও যখন প্রমাণ মেলে না, তখনও তদন্তের নামে, রিপোর্ট আসার নামে, নতুন সূত্র পাওয়ার নামে তাদের আটকে রাখা হয়। বার বার তাদের জামিনের আবেদন নাকচ হয়ে যায়। বছরের পর বছর আদালতে চক্কর কাটতে কাটতে তাদের বাড়ির লোকেদের কলজে আর ট্যাঁকের জোর দুটোই কমে আসে।
আর শাহিদ আজমি ভরা আদালতে দাঁড়িয়ে, পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে এ রকমই অন্তত ১৭ জন মানুষের মুক্তি ছিনিয়ে এনেছেন! এই প্রত্যেকটা মামলায় সওয়াল-জবাবে শুধু ওই মানুষগুলোর অপরাধহীনতাই প্রমাণ হয়নি! প্রত্যেক বারেই পুলিশের প্রায় পার্টিজান-সুলভ হিংস্রতা, প্রশাসনের নিষ্ঠুর দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং রাষ্ট্রের নির্মম উদাসীনতারও হাতে-গরম প্রমাণ মিলেছে। এই কাণ্ডটা যিনি ধারাবাহিক ভাবে ঘটিয়ে এসেছেন, পুলিশ প্রশাসন যে তাঁকে আপদ ভাববে তার আর দোষ কী? শুধু পুলিশ কেন, আরও অনেকেই নিশ্চয় শাহিদকে ভারতবর্ষের মৈত্রী-অখণ্ডতা বা স্বাধীনতা-গণতন্ত্র-সার্বভৌমত্ব-র পক্ষে বিপজ্জনক মনে করত। মুম্বই শহরে, মহারাষ্ট্র প্রদেশে বা গোটা দেশে জাতীয়তাবাদের স্বঘোষিত ঠিকেদার তো কিছু কম নেই। তাই শাহিদ যত দিন বেঁচে থেকেছেন, তথাকথিত সন্ত্রাসবাদীদের মামলা লড়েছেন, তত দিন তাঁর অতীত খোঁড়া হয়েছে। তাঁকে মুসলিম সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের ‘আইনি উপদেষ্টা’ বলা হয়েছে। নিয়মিত ফোন করে হুমকি দেওয়া হয়েছে। যাকে বলে ‘হেট ক্যাম্পেন’, তাঁর গায়ে সেই ক্রমাগত, অবিশ্রান্ত ঘৃণার কালি ছেটানো হয়েছে। মিডিয়াকেও সে কাজে ব্যবহার করা হয়েছে, বা মিডিয়া জেনে-বুঝেই অংশ নিয়েছে। তার পরেও যখন শাহিদ তাঁর ‘মিশন’ থেকে সরলেন না, তখন তাঁর গায়ে-মাথায় গুঁজে দেওয়া হল ক’টা ভাড়াটে বুলেট। মৃত্যুর পরেও তাঁর গায়ে লেপ্টে দেওয়া হয়েছে বিতর্ক: তিনি সত্যিই সুবিচারের পক্ষে ছিলেন, না কি সন্ত্রাসবাদীদের পক্ষে?
শাহিদ আজমির এই ‘বিতর্কিত’ বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার বৃত্তান্ত নিয়ে যে ‘বায়োপিক’ বা জীবনী-ছবিটা সদ্য মুক্তি পেয়েছে, সেখানে রাতদুপুরে আসা ওই হুমকি-ফোনগুলো আছে, কিন্তু শাহিদকে খুন করার জন্য কারা ষড়যন্ত্রের জাল বিছোচ্ছে, সে ব্যাপারে সরাসরি বা পরোক্ষ কোনও রকম মন্তব্যই করা হয়নি। হয়তো পরিচালক অযথা বিতর্ক এড়াতে চেয়েছিলেন, অথবা ‘হুডানিট’ বা ‘খুনি কে’ গোছের গোয়েন্দাগিরির ব্যাপারটাকে তেমন জরুরি মনে করেননি। কারণ, ছবির গোটা ন্যারেটিভটাই একটু একটু করেই চিনিয়ে দিয়েছে শাহিদ আজমির খুনি কারা হতে পারে। কাদের ঠিক কোন পাকা ধানে তিনি কী ভাবে মই-টা দিয়েছিলেন! এমনিতে মনে হবে, শাহিদদের লড়াইটা দেশের প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। বিনা দোষে, বিনা বিচারে, দিনের পর দিন জেল-খাটা মানুষদের পক্ষে। যেখানে তাঁর হাতিয়ার ভারতের সংবিধান, আইন, আদালত। তিহাড় জেলে থাকার সময় এক ‘ভুল করেছিনু ভুল ভেঙেছে’ মনের প্রাক্তন সন্ত্রাসবাদী তাঁকে বলেছিলেন: ‘সিস্টেম’-এর বিরুদ্ধে লড়তে গেলে সিস্টেমের ভেতরে থেকেই লড়া উচিত। কিন্তু শাহিদের আসল লড়াইটা তো এই ‘সিস্টেম’, সমাজ, সরকার ও রাষ্ট্রের মনের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ এক আশ্চর্য চিজ!
শাহিদের শহর মুম্বইয়ের হর্তা-কর্তা-বিধাতারা কেউ কেউ যখন স্লোগান তোলে ‘বাবরের বাচ্চা’রা পাকিস্তানে যাক, তখন সেটা একটু অস্বস্তিকর রকম বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মন মোটের ওপর এটাই চায় যে, ‘বাবরের সন্তানরা’ এ দেশে চোখ নামিয়ে, ঘাড় ঝুঁকিয়ে আশ্রিতের মতো থাকুক। বেশি তেড়িবেড়ি করলে তাদের প্রয়োজন মাফিক টাইট দেওয়া হোক। মোটমাট তাদের অন্তত বুঝিয়ে দেওয়া হোক, আমরা থাকতে দিয়েছি বলেই তোমরা আছ! সংখ্যালঘু তোষণও এই মনোভাবেরই একটু রকমফের। আমরা না দেখলে তোমাদের আর কে দেখবে! সুতরাং, তোমরা কৃতজ্ঞতার ভারে আঁকুপাকু কুজো হয়ে থাকো, আনুগত্যে গলে কেঁচো হও, আমাদের কৃপায় নিজেদের ধন্য মনে করো। বলিউডের সিনেমাও এমনই সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদে ভর করে চলে। এখানে মুসলিম চরিত্ররা দু’ধরনের। হয় সুভদ্র-সেকুলার-ভয়ানক জাতীয়তাবাদী ‘সারে জহাঁসে আচ্ছা’ গাইতে হিন্দুস্তানের জন্য যে-কোনও সময় জান কবুল করছে, নইলে মাফিয়া-ডন কিংবা আই এস আই-এর এজেন্ট ভারতে সন্ত্রাসবাদ ছড়ানোর জন্য সব সময় মতলব আঁটছে।
শাহিদ আজমিকে এদের মধ্যে কোন দলে ফেলা যাবে? ’৯৩-এর মুম্বই দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় শাহিদ জেহাদি হওয়ার জন্য পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে জঙ্গি-শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন। রাহুল গাঁধীও তো সদ্য-সদ্য মন্তব্য করেছেন, আই এস আই বরাবরই দাঙ্গা-পীড়িত মুসলিমদের দলে টানে! উকিল হওয়ার পরেও ‘সন্দেহভাজন বিপজ্জনক’ ‘উগ্রপন্থী’দের হয়ে মামলা লড়েন! আবার, ভারতের আইন-কানুন সংবিধানের ওপরেও ভরসা রাখেন। ইসলামি জঙ্গিদের হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতা দেখে তাদের ডেরা থেকে পালিয়ে আসেন। কিন্তু বলিউডের সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ ‘ভাল’ মুসলিম বলতে যে রকমটা বোঝে, শাহিদ কি সে রকম হতে পারেন? বোধহয় না। কারণ বলিউডের ভাল-মুসলিম ঠিক ‘ধর্মনির্লিপ্ত’ না হলেও, তাকে সংখ্যাগরিষ্ঠের মূলধারার জীবনে লেপ্টে-ভেসে থাকতে হয়। বাদশা-নবাব-অভিজাতদের বাদ দিলে সাধারণ মুসলিম কৌম-জীবন ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’-এর আগে বলিউডে আসেইনি। ‘শাহিদ’-এর পরিচালকও তাঁর ছবির দাঙ্গাপীড়িত, প্রাক্তন সন্ত্রাসবাদী, টাডা-খাটা আইনজীবী মুসলিম যুবকটিকে মুম্বইয়ের টিপিক্যাল মুসলিম মহল্লা, মসজিদ, এমনকি জামাত-এ-উলেমা-এ-মহারাষ্ট্র-র সদর অফিস-ঘেরা জীবনযাপনেই থিতু করেছেন। এমনকী ছবির শাহিদ তার আধুনিকা মুসলিম স্ত্রীকে নিজের মায়ের সঙ্গে আলাপ করাতে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে বোরখা পরতেও বাধ্য করে। বলিউডের সিনেমায় করবা চৌথ পুজোপাঠ ব্রত আচার ঘোমটা সিঁদুর মঙ্গলসূত্রের পাঁচালি দেখে আসা আমাদের চোখেও জিনিসটা খচ করে লাগে। অভ্যেস নেই তো!
এ হেন মুসলিম আইনজীবী যখন মুসলিম মক্কেলের জন্য ভরা আদালতে দাঁড়িয়ে বলেন, আমার মক্কেলকে পুলিশ স্রেফ তার ইসলামি বা আরবি নামের জন্যেই গ্রেফতার করেছে— এই নামটার জন্যই তাকে বিনা বিচারে জেলে পচতে হচ্ছে, সদ্যোজাত ছেলের মুখ অবধি সে দেখতে পায়নি— তখন সেটা আর শুধুই আইনি সওয়াল থাকে না। শুধুই সিস্টেমের গলদটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া থাকে না। পুলিশ-সরকার-আদালত-রাষ্ট্র মিলে কী ভাবে সংখ্যাগুরু ‘পক্ষ’ তৈরি হয়ে যাচ্ছে, আর সেই জোটের সামনে তাদের ‘প্রতি-পক্ষ’ও কী ভাবে নিজেদের আরও বেশি করে আক্রান্ত আর বিচ্ছিন্ন ভাবছে, কওম-এর বাইরে কোথাও ভরসা খুঁজতে পারছে না, ‘শাহিদ’ আমাদের সেই রাষ্ট্রীয় ট্র্যাজেডিরই বৃত্তান্ত হয়ে ওঠে। এখানে তাই শাহিদ আজমিকে কারা খুন করল, সেটা আলাদা করে খুঁজে বার করার দরকার পড়ে না। বরং শাহিদের কাছে আসা হুমকি-ফোনের কয়েকটা শব্দ কানের কাছে গুনগুন করতে থাকে, ‘তুই নিজেকে কী ভাবছিস? জেহাদিদের গাঁধী?’ ‘জেহাদিদের গাঁধী’! সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের আক্রোশ তবে শুধু সংখ্যালঘুকে নয়, গাঁধীকেও বিচ্ছিন্ন-প্রান্তিক-সংকীর্ণ করছে। শাহিদ আজমির জীবনীচিত্র এই কথাটাও মনে পড়িয়ে দিল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.