সাফল্য কথাটি অত্যন্ত আপেক্ষিক। একই সঙ্গে সফল ও অসফল হওয়া সম্ভব, দৃষ্টিকোণের উপর নির্ভর করিয়া। সুতরাং মনমোহন সিংহ যখন তাঁহার দশ বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বের শেষ চিন সফরটি সারিয়া আসিয়া সহাস্য মন্তব্য করেন, ইহা একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য, তখন তাহা বিশ্বাসও করিতে হয়, আবার অবিশ্বাস না করিয়াও উপায়ান্তর থাকে না। বহু দিন ধরিয়া এই সফরের প্রস্তুতি চলিতেছিল। বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদ বলিয়াছিলেন, এই চিন সফর নাকি প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নত করিতে তিনি এতটাই বদ্ধপরিকর। অক্টোবরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বেজিং গমন এবং আগামী মে মাসে চিনা প্রধানমন্ত্রী লি খ্যছিয়াং-এর দিল্লি আগমন, পিঠোপিঠি এই দুই সফর ঘিরিয়া দুই দেশেই উত্তেজনার পারদ বেশ খানিকটা চড়িয়াছিল। বেজিং-এর সংবাদ-মাধ্যম ইহাকে ঐতিহাসিক মুহূর্ত বলিতেও বাকি রাখে নাই। ষাট বৎসরের মধ্যে প্রথম বার দুই দেশের শীর্ষনেতার এই উপর্যুপরি সফর (১৯৫৪ সালের পর) অবশ্যই হেলাফেলার বিষয় নহে। কিন্তু ঐতিহাসিকতা কিংবা সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি তো সময়ের হিসাব হইতে পারে না। সফরে কী মিলিল আর কী মিলিল না, তাহার হিসাবের উপরও কিছুটা নির্ভর করে! সেই বিচারে, এই সফর সফল বলিয়া উৎফুল্ল হওয়া যাইবে কি?
বিশ্বের নবীনতম মহাশক্তিটির সঙ্গে ভারতের স্বার্থ-সংঘর্ষ বহু ও বিচিত্র। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পর্কের কিছুটা অগ্রগতি হইল বলিয়া ধরা যায়, কেননা দুই দেশের মধ্যে বহু-প্রতীক্ষিত বাণিজ্য করিডর বিষয়ে একটি চুক্তি হইয়াছে। বাংলাদেশ ও মায়ানমারের উপর দিয়া প্রস্তাবিত এই সংযোগপথ ভারতের বাজারকে সমৃদ্ধ করিবে। নভেম্বরে দুই দেশের যুগ্ম অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর বৈঠকেও আলোচনা নিশ্চয়ই আগাইবে। কেবল এশিয়ার প্রেক্ষিতেই নহে, গোটা বিশ্বের জন্যই চিন ও ভারতের এই বাণিজ্য-মিত্রতা সুসংবাদ: ‘সিল্ক রুট’-এর গুরুত্ব যদি আবার এই উত্তর-আধুনিক যুগে ফিরাইয়া আনা যায়, তাহার সুফল সারা বিশ্বই লাভ করিবে। আর ভারতের নিজস্ব প্রেক্ষিতে পৃথিবীর অন্যতম অর্থনৈতিক ‘দৈত্য-দেশ’-এর সাহচর্য অর্থনৈতিক ভাবে তো বটেই, কূটনৈতিক ভাবেও অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত দীর্ঘমেয়াদে।
তবে কূটনীতির উন্নতির জন্য এই সফরে প্রধান বিষয় ছিল, সীমান্ত-বিতর্ক। সম্প্রতি যত বার সীমান্তে চিনা বাহিনীর অমায়িক অগ্রসরণ ঘটিয়াছে এবং ভারতের গত্যন্তরহীন হজম-করণ দেখা গিয়াছে, তাহাতে আশা ছিল, এ বার প্রধানমন্ত্রী কিছুটা জোরের সহিত বিষয়টি তুলিবেন। ‘জোর’ অবশ্য মনমোহন সিংহের জোরের জায়গা নহে, সুতরাং চিনা পক্ষ যে নামমাত্র সম্পর্ক-উন্নয়ন চুক্তি করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছে, অরুণাচল হইতে লাদাখ কোনও সমাধানই উচ্চারিত হয় নাই, তাহাতে বিস্মিত হওয়া মুশকিল। সফরের আগেই প্রধানমন্ত্রী সাফাই গাহিয়াছিলেন, সীমান্ত-সমস্যা বিষয়ে তিনি ‘ধীরে-চলো’ নীতির অনুসারী। ধীরে চলা কূটনীতির পরিচিত ধর্ম। কিন্তু এক পক্ষ যদি অতিনমনীয়, এমনকী হীনম্মন্য থাকে, তবে কোনও সীমান্ত সমস্যাই মিটিবার আশা নাই। লি খ্যছিয়াং-এর শীতল, প্রায়-অনিচ্ছুক হস্তটি হাস্যোজ্জ্বল মনমোহন সিংহের ব্যগ্র হস্তে ধৃত: ছবিটি দেখিয়া সেই হতাশাই জন্মে। |